রোবটের পদচারণা : চাকরির ভবিষ্যৎ কি মেশিনের হাতে?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বুদ্ধিমান যন্ত্র কি মানুষের জায়গা নিচ্ছে? না কি প্রযুক্তিই হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় নিয়োগদাতা? রোবোটিক্স ও অটোমেশন প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি কর্মসংস্থানে এই দুই বিপরীত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে পুরো পৃথিবীকে।
বর্তমানে শিল্পকারখানা, চিকিৎসা, কৃষি, ব্যাংকিং, লজিস্টিকস, এমনকি শিক্ষা খাত পর্যন্ত—প্রায় সব সেক্টরেই রোবট এবং স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। মেশিন লার্নিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), এবং বিগ ডেটা অ্যানালিটিক্সের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এক নতুন শিল্প বিপ্লব—যার নাম 'ইন্ডাস্ট্রি ৪.০'।
বৈশ্বিক গবেষণা বলছে, রোবোটিক্স ও অটোমেশন ২০২৭ সালের মধ্যে ৮৩ মিলিয়ন প্রচলিত কাজ সরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু একইসঙ্গে ৬৯ মিলিয়ন নতুন ধরনের চাকরি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। যেমন: রোবট অপারেটর, অটোমেশন মেইনটেন্যান্স স্পেশালিস্ট, AI অ্যানালিস্ট, ডেটা কিউরেটর, এবং ইথিক্যাল হ্যাকিং বা সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট।
বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো—যেমন Amazon, Tesla, Foxconn ও Bosch—ইতোমধ্যেই হাজার হাজার রোবট ব্যবহার করছে গুদামজাতকরণ, প্যাকেজিং, গাড়ি উৎপাদন, ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলে। Foxconn একাই ১০ লাখ রোবটের ম্যানুফ্যাকচারিং ঘোষণা দিয়েছিল তাদের উৎপাদন স্থলে।
বাংলাদেশ ও উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও শ্রমনির্ভর দেশে এই পরিবর্তন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো কৃষি ও উৎপাদনশীল খাতের স্বল্প-দক্ষতার কাজের উপর নির্ভরশীল। হঠাৎ করে রোবোটিক্সের মতো উচ্চপ্রযুক্তি এসব সেক্টরে ঢুকে পড়লে বড় সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
তবে সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, প্রাইভেট ইনস্টিটিউটে রোবোটিক্স-ভিত্তিক কোর্স চালু, এবং স্টার্টআপ ইনকিউবেটর প্ল্যাটফর্ম এই পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কোন কোন খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে?
১. অটোমেশন সফটওয়্যার উন্নয়ন
২. রোবোটিক্স রিসার্চ ও ডিজাইন
৩. AI ও ডেটা সায়েন্স বিশ্লেষণ
৪. ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন কনসাল্টিং
৫. রোবট ট্রেইনার ও মেইনটেন্যান্স টেকনিশিয়ান
৬. স্মার্ট কৃষি (AgriTech)
৭. চিকিৎসা রোবটিক্স (surgical assist, telemedicine)
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো প্রযুক্তি বিপ্লবের সময় পুরনো ধাঁচের কিছু পেশা বিলুপ্ত হলেও, নতুন পেশা তৈরি হয়—যা হয় অধিক বেতনসম্পন্ন ও জ্ঞাননির্ভর। তাই ভয় না পেয়ে প্রয়োজন ভবিষ্যতের স্কিল অর্জনে মনোযোগ দেওয়া।
যে সমস্যাগুলো এখনো বড় বাধা
১। ডিজিটাল লিটারেসির অভাব
২। প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের ঘাটতি
৩। শিক্ষা কারিকুলামে আধুনিক প্রযুক্তির সংযুক্তি না থাকা
৪। ছোট ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত অনুপযুক্ততা
৫। নীতিগত ও নিয়ন্ত্রণমূলক ঘাটতি (Ethical AI ও Data Policy)
কীভাবে প্রস্তুত হব?
১. স্টেম (STEM) শিক্ষা প্রসার
২. কারিগরি ও সফট স্কিল প্রশিক্ষণ
৩. চাকরি ক্ষেত্রের রি-স্কিলিং ও আপস্কিলিং
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া পার্টনারশিপ
৫. ডিজিটাল উদ্যোক্তা গড়ে তোলা ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করা
রোবটিক্স ও অটোমেশনকে ভয় না করে একে বোঝা, আত্মস্থ করা ও কাজে লাগানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। প্রযুক্তি কাউকে বাদ দেয় না—তবে পিছিয়ে পড়া মানুষকে ছেঁটে ফেলে। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে চাকরি নয়, কর্মক্ষেত্রই হয়তো আমাদের পেছনে ফেলে দেবে।
ভবিষ্যতের দুনিয়ায় চাকরি থাকবে তাদেরই, যারা প্রযুক্তিকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করবে।