'স্কুল ড্রপআউট' কমানোর জন্য কমিউনিটি স্কুল কি হতে পারে সমাধান!!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বড় সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের 'স্কুল ড্রপআউট' বা শিক্ষালয় থেকে ঝরে পড়া। শিক্ষানীতিতে নানা রকম পদক্ষেপের পরও, প্রতিবছর লক্ষাধিক শিশু নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ছিটকে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে, শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকরা এখন এক নতুন আশার আলো দেখছেন-কমিউনিটি স্কুল।
স্কুল ড্রপআউট একটি বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যা
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে এই বাধ্যবাধকতা কার্যকর নয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৮.৭% শিশু মাধ্যমিক স্তরে উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। গ্রামীণ ও উপশহর অঞ্চলে এ হার আরও বেশি।
মূল কারণগুলো হলো:
১। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাওয়া
২। অভাবের কারণে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়া
এ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অভিভাবকদের আস্থার অভাব
৪। বাল্যবিবাহ, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে
৫। শিক্ষক সংকট ও স্কুলে পর্যাপ্ত মনোযোগের অভাব
কীভাবে কাজ করে কমিউনিটি স্কুল?
কমিউনিটি স্কুল হলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা শিক্ষাকেন্দ্র, যা শুধুমাত্র পাঠদান নয়, বরং সামাজিক-অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে শিশুদের অনুকূলে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে। এটি শিক্ষাকে শিশুর জীবনের সঙ্গে একীভূত করে।
বিশ্বব্যাপী কমিউনিটি স্কুলের সাফল্য
◑ উগান্ডা ও কেনিয়াতে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুসারে পরিচালিত কমিউনিটি স্কুলে স্কুলছুটের হার কমেছে ৪৫% পর্যন্ত।
◑ ভারতের বিহার ও ওড়িশা রাজ্যে সরকার ও স্থানীয় এনজিও যৌথভাবে চালাচ্ছে 'শিক্ষা প্রকল্প', যেখানে গ্রামীণ অঞ্চলের মেয়েদের জন্য স্থানীয় ভাষায়, নমনীয় সময়সূচিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভাবনা
বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু সংস্থা যেমন ব্র্যাক, গণসাক্ষরতা অভিযান এবং কিছু স্থানীয় এনজিও সীমিত আকারে কমিউনিটি স্কুল চালু করেছে। দেখা গেছে:
⇨ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ৭০%-এর বেশি
⇨ পরিবারগুলোর সচেতনতা বেড়েছে
⇨ স্থানীয় নারী শিক্ষক নিয়োগে মেয়েদের ঝরে পড়া কমেছে
কমিউনিটি স্কুলে থাকে কী কী বৈশিষ্ট্য?
✔ স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার: স্কুলঘর হতে পারে কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদের বারান্দা বা স্থানীয় বাসিন্দার বাড়ির একটি কক্ষ।
✔ সহজ পাঠক্রম: জাতীয় পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে স্থানীয় প্রাসঙ্গিকতা যুক্ত করে শেখানো হয়।
✔ সমন্বিত সেবা: দুপুরে পুষ্টিকর খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসা ও মানসিক পরামর্শের ব্যবস্থা রাখা হয়।
✔ অভিভাবক সম্পৃক্ততা: প্রতি মাসে নিয়মিত মতবিনিময় সভা হয়।
✔ নমনীয় সময়সূচি: শিশুশ্রমে জড়িত বা কৃষিকাজে সহায়ক শিশুদের জন্য বিকল্প সময় রাখা হয়।
নীতি পর্যায়ে জায়গা হচ্ছে কি?
জাতীয় শিক্ষানীতির পর্যালোচনার অংশ হিসেবে বর্তমানে বিকেন্দ্রীকরণ ও সমন্বিত স্থানীয়
শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সভায় ইতিমধ্যেই "কমিউনিটি-ভিত্তিক শিক্ষার মডেল" যুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র বড় পরিসরের প্রতিষ্ঠান দিয়ে সর্বত্র শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। বিকল্প শিক্ষার মডেলগুলো—বিশেষত যেখানে সরকার, স্থানীয় সমাজ ও এনজিও একত্রে কাজ করে—তা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়।
অর্থায়নের সুযোগ কোথায়?
কমিউনিটি স্কুল পরিচালনায় খরচ তুলনামূলকভাবে কম। একটি স্কুল চালাতে গড়ে বছরে খরচ হয় প্রায় ৪-৫ লক্ষ টাকা, যা স্থানীয় সরকার, দাতা সংস্থা ও করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (CSR) তহবিল থেকে সহজে সংগ্রহ করা যেতে পারে।
স্কুল ড্রপআউট মোকাবিলা করতে হলে একটি 'এক আকারে সবার জন্য' পদ্ধতি থেকে সরে আসতে হবে। স্থানীয় বাস্তবতা, সংস্কৃতি ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে শিক্ষার নকশা তৈরি করতে হবে। কমিউনিটি স্কুল সেই কাঠামোটির একটি পরিণত উদাহরণ, যেখানে শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষা নিজেই শিশুদের কাছে এগিয়ে যায়।
সরকার, নীতিনির্ধারক, এবং সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই মডেল দীর্ঘস্থায়ী হতে পারবে না। তবে সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে কমিউনিটি স্কুলই হতে পারে বাংলাদেশের স্কুলছুট সংকটের বাস্তব ও টেকসই সমাধান।