চিকিৎসা এখন হাতের মুঠোয়-স্বাস্থ্যসেবায় মোবাইল অ্যাপে

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে এক নিঃশব্দ, অথচ প্রভাবশালী পরিবর্তনের সূচনা ঘটিয়েছে মোবাইল অ্যাপভিত্তিক সেবা। সময় বাঁচানো, সহজলভ্যতা ও রোগ-ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখার কারণে মোবাইল হেলথ অ্যাপ এখন গ্রাম-শহর সবখানেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। করোনাভাইরাস মহামারির পর এই প্রবণতা আরও বেগ পায়, যখন টেলিমেডিসিন এবং ডিজিটাল হেলথ সলিউশন সাধারণ মানুষের চিকিৎসা গ্রহণের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে।
স্বাস্থ্যসেবার নতুন কাঠামো
বাংলাদেশে বর্তমানে শতাধিক মোবাইল হেলথ অ্যাপ সচল রয়েছে—কিছু সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে, আবার কিছু ব্যক্তি খাতের উদ্ভাবন। এই অ্যাপগুলোর সাহায্যে রোগীরা ডাক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারছেন, ভিডিও কনসালটেশন করতে পারছেন, ই-প্রেসক্রিপশন পাচ্ছেন, এমনকি ওষুধ হোম ডেলিভারিও সম্ভব হচ্ছে। অনেক অ্যাপ আবার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লাইভ চ্যাট, প্রশ্নোত্তর ও ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট বিশ্লেষণের সুবিধাও দিচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, mHealth প্রযুক্তি কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে পারে এমন জনগোষ্ঠীর কাছে, যাদের প্রথাগত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ সীমিত। আর বাংলাদেশে, যেখানে প্রতি ১০,০০০ জনে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা এখনও আন্তর্জাতিক গড়ের নিচে, সেখানে এই প্রযুক্তি একটি কার্যকর 'গ্যাপ ব্রিজিং টুল' হিসেবে কাজ করছে।
রোগ ব্যবস্থাপনায় অ্যাপের ভূমিকা
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, কিডনি রোগসহ দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা ব্যবস্থাপনায় মোবাইল অ্যাপ দারুণ কার্যকর হয়ে উঠছে। রোগীরা তাদের দৈনিক মেডিকেশন রেকর্ড রাখতে পারছেন, ডেটা আপলোড করে রাখছেন ও স্বয়ংক্রিয় রিমাইন্ডার পাচ্ছেন। কিছু অ্যাপ এমনকি ডেটা বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তাও পাঠায়।
উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর অ্যাপগুলোতে এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) ও মেশিন লার্নিং ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মাধ্যমে রোগীর পূর্ববর্তী স্বাস্থ্য ইতিহাস বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি শনাক্ত করা যাচ্ছে। এটি প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বিশেষ সহায়ক।
শিক্ষিত ও তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আগ্রহ
বিশেষত ১৮-৩৫ বছর বয়সী স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনলাইন ফিটনেস অ্যাপ, ক্যালোরি কাউন্টার, স্লিপ ট্র্যাকার কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য থেরাপি বেইসড অ্যাপ—সব মিলিয়ে একধরনের 'ডিজিটাল হেলথ কালচার' গড়ে উঠছে।
বিশ্বব্যাপী mHealth ইন্ডাস্ট্রির বাজার মূল্য ২০২৫ সাল নাগাদ ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এটি বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনের একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
তবে স্বাস্থ্যসেবায় মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কিছু বাস্তব সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন:
১। তথ্য নিরাপত্তা: রোগীর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য তথ্য যথাযথ সুরক্ষায় না থাকলে সাইবার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
২। ভাষাগত সীমাবদ্ধতা: অধিকাংশ অ্যাপ ইংরেজিভিত্তিক, যা নিম্নশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যবহার অনুপযোগী করে তোলে।
৩। বিশ্বাসযোগ্যতা: অনেক অ্যাপে অপ্রমাণিত বা বিভ্রান্তিকর স্বাস্থ্য পরামর্শ থাকে, যা রোগীর ক্ষতির কারণ হতে পারে।
৪। ইন্টারনেট নির্ভরতা: দেশের অনেক অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট এখনও অপ্রতুল, যা ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল হেলথ অ্যাপ ব্যবহারে প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি এবং মান নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সরকার যদি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি অনুযায়ী এই সেবাগুলোকে একটি একীভূত প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেয়, তাহলে জনগণ আরও নিরাপদ ও কার্যকর ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা পাবেন।
একইসাথে, স্থানীয় ভাষায় উপযোগী ও সহজবোধ্য ইন্টারফেস, চিকিৎসকদের অংশগ্রহণ এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি করাও সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি কোম্পানি এবং সরকারি সংস্থার সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম গড়ে উঠলে mHealth বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারবে।
চিকিৎসা আর শুধুই হাসপাতালের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন স্বাস্থ্যসেবাকে করে তুলছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সহজ, এবং সময়োপযোগী। আপনার চিকিৎসা, এখন আপনার হাতেই।