অটোফ্যাজি: কোষের ভেতরে আত্মশুদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধের বৈজ্ঞানিক খতিয়ান

অটোফ্যাজি: কোষের ভেতরে আত্মশুদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধের বৈজ্ঞানিক খতিয়ান
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

খালি পেটে থাকলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে—এই ধারণা এখন সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে। আধুনিক জীববিজ্ঞান বলছে, সঠিক নিয়মে না খেয়ে থাকার একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে শরীর প্রবেশ করে এক জটিল অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায়, যার নাম অটোফ্যাজি (Autophagy)। এর আক্ষরিক অর্থ "নিজেকে খাওয়া", তবে এর প্রভাব আরও গভীর ও সুসংগঠিত।

অটোফ্যাজি কীভাবে কাজ করে?

মানবদেহ প্রতিনিয়ত অসংখ্য কোষে বিভক্ত থাকে, আর প্রতিটি কোষের মধ্যে জন্মায় নানা বর্জ্য পদার্থ, অকেজো প্রোটিন ও মৃত অঙ্গাণু (অর্গানেল)। এসব উপাদান যদি জমতে থাকে, তাহলে কোষের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। এখানেই আসে অটোফ্যাজির গুরুত্ব। এই প্রক্রিয়ায় কোষ নিজেই পুরনো বা ত্রুটিপূর্ণ অংশগুলো 'লাইকোজোম' নামক বিশেষ কাঠামোর মাধ্যমে গিলে ফেলে, বিশ্লেষণ করে এবং পুনঃপ্রক্রিয়ায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। এতে কোষ হয়ে ওঠে পরিশুদ্ধ ও কর্মক্ষম।

অর্থাৎ, অটোফ্যাজি হলো কোষের নিজের ভেতরকার পরিষ্কারের কাজ, ঠিক যেমন একটি শহর তার বর্জ্য পরিষ্কার করে নতুন করে গড়ে ওঠে। এটি শরীরের জৈবিক রিসাইক্লিং সিস্টেমের অংশ।
 

কখন অটোফ্যাজি সক্রিয় হয়?

সাধারণত ১৪ থেকে ২৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকলে শরীরের শর্করা ও ইনসুলিনের মাত্রা কমে যায়। তখন কোষগুলোর স্বাভাবিক শক্তির উৎস (গ্লুকোজ) কমে গিয়ে দেহ 'বিকল্প শক্তি' উৎস হিসেবে কোষের ভেতরের অকেজো অংশ ব্যবহার শুরু করে—এমন সময়েই শুরু হয় অটোফ্যাজি। অর্থাৎ, এই প্রক্রিয়া সক্রিয় হয় একটি নিয়ন্ত্রিত জৈব সংকটের ফলে।
 

কেন অটোফ্যাজি গুরুত্বপূর্ণ?

এই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব শুধু কোষ পরিষ্কারেই সীমাবদ্ধ নয়। অটোফ্যাজি গবেষণায় দেখা গেছে, এটি:

◑ কোষের বার্ধক্য কমাতে সহায়তা করে

◑ স্নায়বিক রোগ যেমন অ্যালঝেইমার ও পারকিনসনের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক

◑ ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে

◑ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করে

◑ কোষীয় প্রদাহ কমিয়ে দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে

◑ কিছু গবেষণায় ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে সহায়ক ভূমিকা রাখার প্রমাণও মিলেছে
 

কে এই প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেন?

অটোফ্যাজি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের নজরে থাকলেও, এটি বিশ্লেষণ ও গবেষণার একটি সুগঠিত কাঠামো প্রদান করেন জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওসুমি, যার জন্য তিনি ২০১৬ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর গবেষণাই আজকের দিনেও অটোফ্যাজি নিয়ে গবেষণার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
 

কীভাবে সক্রিয় করা যায়?

অটোফ্যাজি সাধারণত সক্রিয় হয় ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (Intermittent Fasting) বা সীমিত ক্যালোরি গ্রহণের মাধ্যমে। যেমন:

◑ ১৬:৮ মডেল: দিনে ১৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা এবং ৮ ঘণ্টার মধ্যে খাবার গ্রহণ

◑ ২৪ ঘণ্টা উপবাস: সপ্তাহে একবার দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা

◑ ৫:২ পদ্ধতি: সপ্তাহে পাঁচ দিন স্বাভাবিক খাবার এবং দুই দিন খুব কম ক্যালোরি
 

শরীর ধীরে ধীরে এই অভ্যাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, এবং সময়ের সঙ্গে অটোফ্যাজির প্রক্রিয়াটি আরও সক্রিয় হয়। তবে এটি গর্ভবতী নারী, শিশু, ডায়াবেটিস রোগী, হরমোন সমস্যা বা অতি দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা উচিত নয়।
 

অটোফ্যাজি কি ওজন কমায়?

এটি সরাসরি ওজন কমানোর পদ্ধতি না হলেও, অটোফ্যাজির মাধ্যমে শরীর শক্তির জন্য জমে থাকা অতিরিক্ত বর্জ্য ব্যবহার করে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে এটি শরীরের বিপাকহারের উন্নতি ঘটায়, ইনসুলিন কার্যক্ষমতা বাড়ায়, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

শুধু খাদ্য পরিহার নয়, বিজ্ঞান বলছে—সঠিকভাবে উপবাস মানে নিজের শরীরকে একটি স্মার্ট ক্লিনিং মেশিনের মতো কাজ করতে দেওয়া। এই অভ্যন্তরীণ জৈবিক পরিষ্কারের প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। নিয়ম মেনে উপবাস করা মানে হতে পারে কোষীয় স্তরে নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া, যা দীর্ঘজীবন ও রোগমুক্ত জীবনধারার অন্যতম চাবিকাঠি হতে পারে।


সম্পর্কিত নিউজ