নীরব ঘাতক ইউরিন ইনফেকশন

নীরব ঘাতক ইউরিন ইনফেকশন
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে আমরা ছোটখাটো কিছু উপসর্গকে অবহেলা করে থাকি—যেমন বারবার প্রস্রাবের চাপ, হালকা জ্বালাপোড়া বা নিচের পেটে অস্বস্তি। অনেকেই ভাবেন, পানি কম খাওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে এসবই হতে পারে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের (UTI) প্রাথমিক সংকেত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের প্রতি ২ জন নারীর মধ্যে অন্তত ১ জন জীবনে একবার হলেও ইউটিআইতে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও বিষয়টি উদ্বেগজনক। বিশেষ করে, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, অপরিচ্ছন্ন টয়লেট, পানি ঘাটতি এবং সচেতনতার অভাবের কারণে ইউটিআই দ্রুত বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে কিডনি, প্রজনন স্বাস্থ্য ও জীবনমানের ওপর।

ইউটিআই কীভাবে হয়?

ইউটিআই মূলত মূত্রনালির যেকোনো অংশে (মূত্রথলি, মূত্রনালি, ইউরেথ্রা, এমনকি কিডনি পর্যন্ত) ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত একটি অসুখ। প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে Escherichia coli (E. coli) নামের একধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত অন্ত্রে থাকে। কিন্তু হাইজিন মেনে না চললে, এই ব্যাকটেরিয়া সহজেই ইউরেথ্রা দিয়ে মূত্রথলিতে প্রবেশ করে সংক্রমণ সৃষ্টি করে।
 

কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?

⇨ নারীরা: শরীরের গঠনগত কারণে নারীদের ইউরেথ্রা ছোট ও মূত্রথলির কাছে হওয়ায় ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ সহজ হয়।

⇨ প্রসূতি ও গর্ভবতী নারীরা: হরমোনাল পরিবর্তন ও ইউরিনারি ট্র্যাক্টে চাপ বৃদ্ধির ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

⇨ ডায়াবেটিস রোগী: উচ্চ রক্তশর্করা ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

⇨ বয়স্করা: বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পায়, ফলে সংক্রমণ বেশি হয়।

⇨ বাচ্চারা: যথাযথ টয়লেট হাইজিন না মানায় শিশুদের মধ্যেও ইউটিআই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
 

উপসর্গ ও লক্ষণ

⇨ ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ, বিশেষ করে অল্প পরিমাণে

⇨ প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া

⇨ নিচের পেটে ভারী অনুভব

⇨ প্রস্রাবে দুর্গন্ধ

⇨ প্রস্রাবে রক্ত

⇨ ক্লান্তি, জ্বর, বমি (সংক্রমণ কিডনিতে পৌঁছালে)
 

অনিয়মেই বিপদ

আমরা প্রতিদিন যেসব কাজ 'স্বাভাবিক' বলে ধরে নিই, সেগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ইউটিআইয়ের মূল কারণ। যেমন:

১.  প্রস্রাব আটকে রাখা: দীর্ঘসময় প্রস্রাব চেপে রাখা মূত্রথলিতে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

২.  অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার: পাবলিক টয়লেট বা বাসার অপরিচ্ছন্ন টয়লেট সরাসরি সংক্রমণের পথ খুলে দেয়।

৩.  পানি কম খাওয়া: পরিমিত পানি না খেলে ইউরিন কম হয়, ফলে মূত্রনালির ব্যাকটেরিয়া ধুয়ে বের হতে পারে না।

৪.  সঠিকভাবে পরিষ্কার না হওয়া: বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে টয়লেট ব্যবহারের পর সামনে থেকে পিছনের দিকে পরিষ্কার না করলে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ইউরেথ্রায় পৌঁছাতে পারে।
 

প্রতিরোধের উপায়

১. পরিমিত পানি পান করুন: দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি খেলে ব্যাকটেরিয়া ইউরিনের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়।

২. টয়লেট হাইজিন বজায় রাখুন: পরিষ্কার ও শুকনো টয়লেট ব্যবহার করুন, টয়লেট সিট পরিষ্কার রাখুন।

৩. যৌনস্বাস্থ্য সচেতনতা: যৌনসম্পর্কের পর প্রস্রাব করুন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।

৪. কাপড়চোপড়ের যত্ন: আঁটসাঁট বা ঘামযুক্ত আন্ডারওয়্যার নয়, তুলোর তৈরি ঢিলেঢালা ও শুকনো অন্তর্বাস পরুন।

৫. সাবধানভাবে প্যাড ব্যবহার: স্যানিটারি প্যাড ৪-৬ ঘণ্টা পরপর পরিবর্তন করুন, বিশেষ করে গরমকালে।
 

চিকিৎসা ও ভুল ধারণা

UTI সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকে সেরে যায়, তবে এন্টিবায়োটিক সেবনের আগে সংক্রমণের ধরন বুঝে পরীক্ষা করানো উচিত। অনেকেই নিজে নিজে ওষুধ খেতে শুরু করেন, যা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—"নিজে থেকে ওষুধ নয়, বরং প্রস্রাবের কালচার বা ইউরিন রিপোর্ট করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।"
 

ইউটিআইয়ের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে কী?

⇨ বারবার সংক্রমণ হলে কিডনির ক্ষতি হতে পারে

⇨ গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে সময়ের আগে প্রসব বা শিশুর ওজন কম হতে পারে

⇨ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হলে ভবিষ্যতে অন্য সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে

⇨ মানসিক চাপ, কাজের ব্যাঘাত ও জীবনমানের অবনতি ঘটায়

 

ইউরিন ইনফেকশন কোনো সামান্য বিষয় নয়। এটি একদিকে যেমন যন্ত্রণাদায়ক, অন্যদিকে চিকিৎসা বিলম্ব হলে হতে পারে প্রাণঘাতীও। সঠিক সচেতনতা, হাইজিন এবং জীবনধারায় সামান্য পরিবর্তন এনে নিজেকে ও পরিবারকে এই নীরব শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

স্বাস্থ্যসচেতনতা শুরু হোক আজ থেকেই—নিজেকে জানুন, সুস্থ থাকুন।


সম্পর্কিত নিউজ