ডিগ্রি না দক্ষতা? তরুণদের ভবিষ্যৎ গড়ার দিশা কোথায়?

ডিগ্রি না দক্ষতা? তরুণদের ভবিষ্যৎ গড়ার দিশা কোথায়?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বর্তমান বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল শ্রমবাজার, প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি, ও উচ্চ বেকারত্বের প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে—উচ্চশিক্ষা (Academic Education) নাকি কর্মমুখী শিক্ষা (Vocational/Technical Education) তরুণদের জন্য অধিক ফলপ্রসূ? বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে এই প্রশ্নটি এখন নীতিনির্ধারকদের কাছেও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উচ্চশিক্ষার অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ:

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বিস্তৃত বিষয়ের উপর তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করেও এদের বড় একটি অংশ বেকার থেকে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে স্নাতক বা তারও উপরের ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২.৮%, যেখানে জাতীয় গড় বেকারত্ব ৪-৫% এর মধ্যে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত পরীক্ষানির্ভর ও পাঠ্যবইভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হয়। বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান, দক্ষতা অনুশীলন বা ইন্ডাস্ট্রি-সংলগ্ন শিক্ষা সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জনের পরও চাকরির জন্য প্রস্তুত থাকে না।
 

কর্মমুখী শিক্ষার চাহিদা ও ভবিষ্যৎ:

কর্মমুখী শিক্ষা বলতে বোঝায় এমন একটি শিক্ষা যেখানে ছাত্রছাত্রীরা নির্দিষ্ট স্কিল বা ট্রেডে প্রশিক্ষণ নেয়—যেমন ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, ওয়েল্ডার, গ্রাফিক ডিজাইনার, সফটওয়্যার ডেভেলপার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ান, বা ডিজিটাল মার্কেটার।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (WEF) "Future of Jobs Report 2023"-এর মতে, ২০২৭ সালের মধ্যে প্রায় ৮৩ মিলিয়ন চাকরি অপ্রচলিত হয়ে যাবে, কিন্তু ৬৯ মিলিয়ন নতুন চাকরি তৈরি হবে, যার সিংহভাগই হবে স্কিলভিত্তিক। বাংলাদেশেও কর্মমুখী শিক্ষা প্রাপ্ত যুবকদের কর্মসংস্থানের হার প্রায় ৬০% বেশি, বিশেষ করে বিদেশগামী শ্রমবাজারে।
 

প্রযুক্তি ও অটোমেশনের প্রভাব:

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, ডেটা অ্যানালিটিক্স, ও ক্লাউড কম্পিউটিং-এর মতো খাতে যে দক্ষতা প্রয়োজন, তা সরাসরি কর্মমুখী বা কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। বিশ্বব্যাপী যেমন Coursera, edX, Udemy-এর মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন টেকনিক্যাল স্কিল শেখার হার বেড়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও ICT Division ও LICT প্রকল্পের অধীনে হাজার হাজার তরুণ ফ্রিল্যান্সিং ও আইটি-ভিত্তিক প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন।


শিক্ষাব্যবস্থার সম্ভাব্য সমাধান:

নতুন প্রজন্মকে কেবল তাত্ত্বিক শিক্ষা দিয়ে নয়, বাস্তবমুখী জ্ঞান ও স্কিল দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজন:

⇨ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি

⇨ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কিল-বেইজড কোর্স অন্তর্ভুক্তি

⇨ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (PPP) ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন

⇨ ইন্টার্নশিপ ও অ্যাপ্রেন্টিসশিপ বাধ্যতামূলক করা

⇨ "Recognition of Prior Learning (RPL)" পদ্ধতি চালু করা
 

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শেখার সুযোগ:

জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে "ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম" চালু রয়েছে—যেখানে একসাথে তাত্ত্বিক ও বাস্তব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই মডেল অনুসরণ করলে বাংলাদেশের মতো দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সহজ হবে, যা স্থানীয় ও বৈশ্বিক উভয় শ্রমবাজারেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সক্ষম হবে।

আজকের তরুণদের জন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন যথেষ্ট নয়। পরিবর্তিত সময় ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনই তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার মূল চাবিকাঠি। একটি টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা গড়তে হলে উচ্চশিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষার মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং তাদের সংযুক্তি ও ভারসাম্যই হতে হবে মূল লক্ষ্য।


সম্পর্কিত নিউজ