অলসতা কি ব্যর্থতা, না কি জীবনের ভারসাম্য রক্ষার বুদ্ধিদীপ্ত এক অভ্যাস?

অলসতা কি ব্যর্থতা, না কি জীবনের ভারসাম্য রক্ষার বুদ্ধিদীপ্ত এক অভ্যাস?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

অলসতা-একটি শব্দ, যার নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বিরক্তিকর এক ব্যক্তির মুখচ্ছবি, যিনি সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকেন, কাজ এড়িয়ে চলেন, আর সময় অপচয় করেন। সমাজ, পরিবার, এমনকি নিজের বিবেকও যেন অলস মানুষদের বিরুদ্ধে একাট্টা। কিন্তু আমরা কি সত্যিই জানি, 'অলসতা' বলতে কী বোঝায়?

সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, অলসতা কেবল মানসিক দুর্বলতা বা দায়িত্ব এড়ানোর নাম নয়—এটি হতে পারে জীববিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে এক গভীরভাবে প্রোগ্রামড, আত্মরক্ষামূলক মস্তিষ্কীয় কৌশল।
 

মস্তিষ্কের এনার্জি অপটিমাইজেশন মেকানিজম?

মানব মস্তিষ্কের প্রায় ২০% শক্তি খরচ হয়, যদিও এটি শরীরের মাত্র ২% স্থান দখল করে। তাই মস্তিষ্ক সর্বদা এমনভাবে কাজ করতে চায় যাতে কম পরিশ্রমে বেশি ফল পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন "Effort-Reward Imbalance" — যখন একটি কাজ থেকে প্রাপ্ত পুরস্কার বা ফলাফল কাঙ্ক্ষিত নয়, তখন মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই কাজ এড়িয়ে যায়। ফলে তৈরি হয় অলসতা।

অন্যদিকে, নিউরোসাইকোলজিস্টরা বলছেন, এই অলস আচরণ অনেক সময় মস্তিষ্কের একটি "সেলফ-প্রিজারভেশন" কৌশল। এটি আমাদেরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ হওয়া থেকে রক্ষা করে। মানে, আপনি যদি বারবার কোন কাজ শুরু করতে না চান, সেটা আপনার মস্তিষ্কের পক্ষ থেকে একটি "পজ সিগন্যাল" হতে পারে—যেটি বলছে: 'এখন না, আমি ক্লান্ত।'
 

অলসতা বনাম প্রোডাক্টিভিটি

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন নির্ধারিত সময় কাজ করেন এবং মাঝেমধ্যে "স্ট্রাকচার্ড অলসতা"—অর্থাৎ পরিকল্পিত বিশ্রাম বা অনাবশ্যক কাজ না করে সময় ব্যয় করেন—তারা কর্মক্ষমতায় বেশি এগিয়ে থাকেন।

Google, Microsoft-এর মতো বড় টেক কোম্পানিগুলোও এখন কর্মীদের মাঝে 'Mindful Laziness' বা 'Creative Downtime' প্র্যাকটিস চালু করছে—যার মাধ্যমে কর্মীরা কাজের মাঝে নির্দিষ্ট বিরতি নিয়ে নিজেকে পুনর্গঠন করতে পারেন।
 

অলসতা ও স্নায়ুবিজ্ঞানের সংযোগ

অলসতা সরাসরি যুক্ত আমাদের ব্রেইনের ডোপামিন সিস্টেমের সাথে। ডোপামিন হলো এমন এক নিউরোট্রান্সমিটার, যা আমাদের 'ইচ্ছা', 'উৎসাহ' এবং 'পুরস্কার বোধ' নিয়ন্ত্রণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডোপামিনের ভারসাম্যহীনতায় অনেক সময় মানুষ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে—যা আমরা 'অলসতা' বলে ধরে নিই।

এছাড়া ADHD, ডিপ্রেশন, বা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রেও 'অলসতা' একটি কমন লক্ষণ হিসেবে ধরা পড়ে। তাই কাউকে শুধুমাত্র অলস বলে তিরস্কার না করে, তার মানসিক অবস্থার অনুসন্ধান করাও দরকার।
 

অলসতার ইতিবাচক দিক কী?

অলস সময়ে আমরা যখন কিছু করি না—ঠিক সেই সময়ই মস্তিষ্কের Default Mode Network (DMN) সক্রিয় হয়। এই DMN-এর কাজ হলো স্মৃতি রিভিউ করা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা এবং সৃজনশীল চিন্তা করা। অনেক মনীষী যেমন আইজ্যাক নিউটন, আর্কিমিডিস এমনকি আইনস্টাইনও তাঁদের বিখ্যাত আইডিয়াগুলো ভেবেছেন একাকী সময় কাটানোর সময়—যা আপনি বলবেন "অলস সময়"!
 

তাহলে কীভাবে বুঝবেন আপনার অলসতা 'স্বাভাবিক' না 'বিপদজনক'?

 ১। স্বাভাবিক অলসতা:

⇨ ক্লান্তির কারণে সাময়িক বিশ্রামের ইচ্ছা

⇨ নির্দিষ্ট কাজের প্রতি অনীহা, তবে অন্য কাজে উৎসাহ

⇨ কাজের মাঝে বিরতি নেওয়া
 

২। বিপজ্জনক অলসতা:

⇨ দিনের পর দিন কিছু না করার মানসিকতা

⇨ ভবিষ্যৎ নিয়ে আগ্রহহীনতা

⇨ আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি

⇨ মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন, বা উদ্বেগের অন্যান্য উপসর্গ


অলসতা থেকে মুক্তি পেতে করণীয়:

⇨ ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন ও ধাপে ধাপে এগোতে থাকুন

⇨ প্রাত্যহিক রুটিন বানান

⇨ পর্যাপ্ত ঘুম ও হাইড্রেশন নিশ্চিত করুন

⇨ স্ক্রিন টাইম কমান, প্রকৃতির সংস্পর্শে যান

⇨ হালকা ব্যায়াম বা মেডিটেশনের অভ্যাস গড়ে তুলুন
 

অলসতা সব সময়ই খারাপ কিছু নয়। এটি হতে পারে আপনার ক্লান্তির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, সৃজনশীলতার উপহার কিংবা মননশীল রিফ্রেশিং পিরিয়ড। তবে যদি এটি আপনার জীবনে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাঘাত ঘটায়, আত্মসম্মান ও সামাজিক সম্পৃক্ততা কমায়, তখন তা অনিবার্যভাবে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ইঙ্গিত—যা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া জরুরি।

তাই অলসতা মানেই ব্যর্থতা নয়—বরং একে বুঝে নিয়ে ব্যালান্স করা গেলে, তা হতে পারে সাফল্যের নতুন এক সোপান।


সম্পর্কিত নিউজ