গাছের শরীরের রাসায়নিক হরমোনের বিস্ময়কর কার্যকলাপ

গাছের শরীরের রাসায়নিক হরমোনের বিস্ময়কর কার্যকলাপ
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আমাদের চারপাশের পরিবেশে গাছগুলো যেন স্থির এক মঞ্চের নীরব অভিনেতা। তারা কথা বলে না, চিৎকার করে না, কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ন্ত্রণ করে এক জটিল রাসায়নিক ভাষা-উদ্ভিদ হরমোন।

এগুলো গাছের বৃদ্ধি, বিকাশ, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো এবং প্রজনন প্রক্রিয়াকে ধারাবাহিকতা দেয়।

বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদের এই 'হরমোন' বা গ্রোথ রেগুলেটরগুলোকে "উদ্ভিদের অভ্যন্তরীণ রসায়ন" হিসেবে অভিহিত করেছেন, যা তাদের জীবনের নানা মূহুর্তে সঠিক সংকেত পাঠায়।
 

১. অক্সিন (Auxin): গাছের বৃদ্ধির প্রধান নির্দেশক

অক্সিন গাছের শিকড় ও কুঁড়ি থেকে উৎপন্ন হয় এবং এটি গাছের কোষ বৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন গাছটি আলো থেকে সরে গিয়ে বেঁকে যায়, তখন অক্সিন কোষের একপাশে বেশি সক্রিয় হয়ে সেই দিকের কোষ বৃদ্ধি পায়, ফলে গাছ বাঁক নেয়। এটি কেবল বৃদ্ধিই নিয়ন্ত্রণ করে না, গাছের ফুল ও ফল গঠনের প্রক্রিয়াতেও সাহায্য করে।
 

২. জিবেরেলিন (Gibberellin): লম্বা হওয়ার শক্তি

জিবেরেলিন মূলত গাছের লম্বা হওয়ার এবং বীজের অঙ্কুরোদ্গমে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে শস্যজাতীয় গাছে এর উপস্থিতি ফলন বাড়াতে সাহায্য করে। এক ধরনের উদ্ভিদ রোগ থেকে প্রাপ্ত জিবেরেলিন ব্যবহার করে কৃষকেরা গাছের বৃদ্ধিতে বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হচ্ছেন।
 

৩. সাইটোকাইনিন (Cytokinin): কোষ বিভাজনের কারিগর

সাইটোকাইনিন গাছের কোষ বিভাজন বাড়িয়ে নতুন টিস্যু গঠনে সাহায্য করে। এটি পাতার বার্ধক্যপ্রক্রিয়া দেরি করে এবং শিকড় ও পাতার মধ্যে পুষ্টি সঠিকভাবে বিতরণ নিশ্চিত করে। ফলস্বরূপ গাছ দীর্ঘস্থায়ী ও স্বাস্থ্যবান থাকে।
 

৪. অ্যাবসিসিক অ্যাসিড (Abscisic Acid): গাছের 'স্ট্রেস রেসপন্ডার'

জলশূন্যতা, উচ্চ তাপমাত্রা কিংবা অন্যান্য পরিবেশগত চাপের সময় গাছের অভ্যন্তরে অ্যাবসিসিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়। এটি পাতার ছোট ছিদ্র (স্টোমাটা) বন্ধ করে জল ক্ষরণের হার কমায়, ফলে গাছের জন্য টেকসই জীবনযাত্রা সম্ভব হয়।
 

৫. ইথিলিন (Ethylene): ফল পাকানো ও পতনের নিয়ন্ত্রক

ইথিলিন হলো একমাত্র গ্যাসীয় উদ্ভিদ হরমোন, যা ফল পাকানো, ফুল ফোটানো এবং পাতা ঝরার প্রক্রিয়ার প্রধান নিয়ন্ত্রক। এটি গাছের জীববৃত্তের বিভিন্ন পর্যায়কে সঠিক সময়ে সমাপ্ত করতে সাহায্য করে।
 

উদ্ভিদ হরমোন ও আধুনিক কৃষি

আজকের উন্নত কৃষিতে উদ্ভিদ হরমোনের ব্যবহার বিপ্লব ঘটিয়েছে। কৃষকেরা এখন এসব হরমোন ব্যবহার করে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারেন, শস্যের উৎপাদন বাড়াতে পারেন, এমনকি নির্দিষ্ট রোগ ও পরিবেশগত চাপ থেকে গাছকে রক্ষা করতে পারেন। উদ্ভিদ টিস্যু কালচারে হরমোনের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ করেই উচ্চমানের জাত উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
 

বিশ্বের নানা গবেষণায় উদ্ভিদের হরমোনের গুরুত্ব

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় উদ্ভিদ হরমোনের কাজ এবং তাদের প্রয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, হরমোনের নিয়ন্ত্রণেই গাছের দেহে কোষের আকার ও সংখ্যা বাড়ানো যায়, যা ভবিষ্যতে খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

গাছের হরমোনগুলো না শুধুমাত্র তাদের জীবনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে, বরং পুরো পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষাতেও অবদান রাখে। যখন আমরা গাছের এই রাসায়নিক বার্তাবাহকদের গুরুত্ব বুঝতে পারব, তখন প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্বও আরও বেড়ে যাবে।


সম্পর্কিত নিউজ