করোনা মহামারির ইতিহাসে ডেল্টা এবং ওমিক্রন দুটি মাইলফলক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ডেল্টা তীব্র এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, যা বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে প্রায় ভেঙে দিয়েছিল। তবে, ওমিক্রন এসেছে নতুন রূপে — অতি দ্রুত ছড়ানো, তবে তুলনামূলকভাবে কম গুরুতর উপসর্গসহ। এখন, সেই ওমিক্রনের আরেক ধাপ XBB, যা একটি রিকম্বিন্যান্ট সাবভ্যারিয়েন্ট, অর্থাৎ ওমিক্রনের দুই ভিন্ন ধরন একত্রিত হয়ে গঠন করেছে।
 

XBB কীভাবে ভিন্ন?

XBB ভিন্নতার মূল কারণ এর জিনোমে মিউটেশনগুলো, যা ইমিউন সিস্টেমের সুরক্ষা ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

গবেষণা থেকে জানা গেছে, XBB মূলত অ্যান্টিবডি-নিরপেক্ষতা (antibody evasion) বাড়িয়ে মানুষের আগে হওয়া টিকা বা সংক্রমণের স্মৃতির বিরুদ্ধে আরও দক্ষ। ফলে, যাদের আগে করোনা হয়েছে বা টিকা নিয়েছে, তারা এই সাবভ্যারিয়েন্ট থেকে একেবারেই নিরাপদ নয়।
 

ডেল্টার সঙ্গে XBB-এর তুলনা

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রোগীর ফুসফুসে গভীর সংক্রমণ ঘটাতো, যার ফলে সিভিলিয়ান হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। অপরদিকে, XBB বেশি করে শ্বাসনালী ও নাকের উপরের অংশে আক্রমণ চালায়, যার ফলে উচ্চ সংক্রমণ হার, কিন্তু কম গুরুতর 

শারীরিক ক্ষতি দেখা যায়।
 

মূল পার্থক্য-

➤সংক্রমণ ক্ষমতা:

⇨ডেল্টা: দ্রুত ছড়ায়

⇨XBB: ডেল্টার থেকে আরও দ্রুত ছড়ায়

➤রোগের গম্ভীরতা:

⇨ডেল্টা: বেশি গুরুতর রোগ হয়

⇨XBB: সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি রোগ হয়

➤ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম প্রতিরোধ):

⇨ডেল্টা: টিকা ও আগের সংক্রমণ থেকে কিছু সুরক্ষা পাওয়া যায়

⇨XBB: অনেক বেশি সুরক্ষা ফাঁকি দিতে পারে, টিকা কম কাজ করে

➤ শ্বাসনালীর আক্রান্ত স্থান:

⇨ডেল্টা: নিচু শ্বাসনালী ও ফুসফুসে আক্রমণ করে

⇨XBB: প্রধানত নাক ও গলার উপরের অংশে আক্রমণ করে

➤ টিকার প্রভাব:

⇨ডেল্টা: টিকা বেশ কার্যকর ছিল

⇨XBB: টিকার কার্যকারিতা কিছু কমে গেছে, তবে বুস্টার ডোজ সাহায্য করে

➤ উপসর্গ:

⇨ডেল্টা: জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সমস্যা বেশি

⇨XBB: সর্দি, গলা ব্যথা, হালকা জ্বর বেশি

➤ ঝুঁকি কারা বেশি:

×ডেল্টা: বয়স্ক ও রোগপ্রবণ ব্যক্তিদের জন্য খুব বিপজ্জনক

⇨XBB: সাধারণত কম গুরুতর, তবে ঝুঁকিপূর্ণদের সতর্ক থাকতে হবে

এভাবেই ডেল্টা ও XBB একে অন্যের থেকে আলাদা এবং আমাদের প্রতিরোধের জন্য ভিন্ন প্রস্তুতি দরকার।

 

গবেষণার নতুন তথ্য:

◑ অ্যান্টিবডি রেসিস্ট্যান্স: XBB এর বিভিন্ন মিউটেশন Spike প্রোটিনে বিশেষ ধরনের পরিবর্তন এনেছে, যা টিকা এবং পূর্ব সংক্রমণের ফলে তৈরি অ্যান্টিবডি গুলোকে "বাইপাস" করতে পারে।

◑ বৃদ্ধি ও বুস্টার ডোজ: গবেষকরা বলছেন, যদিও টিকার কার্যকারিতা কিছুটা কমেছে, তবে বুস্টার ডোজ (তৃতীয় বা চতুর্থ ডোজ) এই সাবভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা দিতে সক্ষম।

◑ বিভিন্ন দেশে পরিস্থিতি: সিঙ্গাপুর, ভারতসহ একাধিক দেশে XBB-এর দ্রুত সংক্রমণ ঘটেছে, তবে হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যু হার তুলনামূলক কম।

◑ মানবদেহের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

XBB-এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ফলে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লেও, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, বড় বড় জনসমাবেশ এড়ানো, মাস্ক ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মানা এখনো অপরিহার্য।
 

টিকা ও বৈজ্ঞানিক অভিযোজন

বর্তমানে Pfizer, Moderna সহ বিভিন্ন কোম্পানি ওমিক্রন সাবভ্যারিয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে নতুন বুস্টার ডোজ তৈরি করছে যা XBB সহ ভবিষ্যতের মিউটেশনগুলোর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারবে। বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, করোনার ভবিষ্যৎ রূপ বুঝতে নিয়মিত জিনোম পর্যবেক্ষণ এবং দ্রুত আপডেটেড টিকা তৈরি বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে।
 

করোনা ভাইরাসের এই ধারাবাহিক পরিবর্তন মানবজাতির জন্য এক বড় স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। ডেল্টার তীব্রতা ও ওমিক্রন XBB এর সংক্রমণ ক্ষমতার মিশেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নতুন রকম প্রস্তুতির দরকার। সচেতনতা, টিকা গ্রহণ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি মনোযোগই পারে এই মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে।