হজের পর ইসলামী জীবনযাপন বজায় রাখা কতটা জরুরি?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
হজ শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এটি এক নতুন আত্মশুদ্ধির শুরু, আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার অঙ্গীকার। প্রতিবছর লাখো মুসলমান হজব্রত পালন করেন, চোখে অশ্রু, মুখে তাওবার বাণী। কিন্তু হজ শেষে দেশে ফিরে সেই পরিবর্তন কতটা স্থায়ী হয়? কেনই বা এই পরিবর্তন ধরে রাখা অপরিহার্য?
হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর পথে ফিরে আসা - পবিত্র হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ, যা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এবং আত্মিকভাবে একজন মানুষকে সংযম ও আত্মনিবেদনের চূড়ান্ত শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। মহানবী (সা.) বলেন:
"যে ব্যক্তি হজ করল এবং অশ্লীল ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকল, সে এমনভাবে ফিরে আসে যেমন মায়ের গর্ভ থেকে সদ্য জন্ম নিয়েছে।" — (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৫২১)
অর্থাৎ হজ হলো পূর্ণ আত্মবিশুদ্ধি ও জীবনের নবযাত্রা। তবে এই নবযাত্রা যদি কেবল মক্কা-মদিনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে, তা হলে হজের প্রকৃত ফসল কাটা হয় না।
ইবাদতের ধারাবাহিকতা: হজ একটি শুরু, শেষ নয়
হজের পর একজন মুসলমানের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে ইবাদতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। হজের সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়ানুবর্তিতা, দুনিয়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে শুধু আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া—এই অভ্যাস যেন জীবনের প্রতিটি স্তরে জারি থাকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তারা দৃঢ় থাকল—তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।" — (সূরা আহকাফ, আয়াত ১৩)
সুতরাং হজের পর যাঁরা আবার আগের মতই নামাজে গাফিল, কথায় মিথ্যা, লেনদেনে অসৎ হয়ে পড়েন—তাঁদের হজের প্রকৃত প্রভাব সমাজে প্রতিফলিত হয় না।
সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব
হজ শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, বরং এটি সমাজিক দ্বায়িত্ববোধও তৈরি করে। আল্লাহভীতির যে শক্তি একজন হজযাত্রী অর্জন করেন, তা কেবল নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজে ছড়িয়ে দিতে হয়।
"তোমরা উত্তম উম্মত, মানুষদের কল্যাণের জন্যই তোমাদের বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো।" - (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০)
আজকের সমাজে হজপালনকারী ব্যক্তিদের উচিত—
দানশীলতা বৃদ্ধি করা, দুর্নীতি, সুদ ও ঘুষ থেকে বিরত থাকা পারিবারিক ও সামাজিক শান্তির জন্য কাজ করা
নতুন প্রজন্মকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা দেওয়া
বাস্তব চিত্র-
হজ পালনকারী অনেকেই দেশে ফিরে ধর্মীয় অনুশীলনে আরও সক্রিয় হন। কিছু হজযাত্রী হজের আবেগ ধরে রাখতে না পেরে আগের জীবনের গাফিলতায় ফিরে যান। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়দের অনুৎসাহ, সমাজের চাপ, এমনকি পারিবারিক অসচেতনতা—সবই তাদের পুনরায় ভুল পথে টেনে নেয়।
হজের শিক্ষা জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে করণীয়
☞ ইবাদতের রুটিন গড়ে তোলা:
⇨পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, বিশেষ করে ফজর ও ইশা ⇨জামাতের সঙ্গে পড়া।
প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস।
☞ আখলাক (চরিত্র) উন্নয়ন:
⇨সততা, বিনয়, সহনশীলতা ও দয়া প্রদর্শন।
⇨পেশাগত ও পারিবারিক জীবনে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন।
☞ আল্লাহভীতির সঙ্গে হালাল জীবিকা অর্জন:
⇨সুদ ও ঘুষমুক্ত ব্যবসা ও চাকরি।
⇨যাকাত, দান ও সাহায্যকার্যে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
☞ সামাজিক দৃষ্টান্ত স্থাপন:
⇨ইসলামী আদর্শের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা।
⇨শিশুদের ইসলামি শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা।
হজের পর জীবনে যদি প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিফলিত না হয়, তবে হজ কেবল একটি আনুষ্ঠানিক সফরে রূপ নেয়। হজ যেন আমাদের প্রতিটি দিনের চিন্তা, কাজ ও সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়—এটাই সঠিক হজের মাকবুল হওয়ার প্রমাণ।
"আল্লাহ তাদের প্রতি রাগান্বিত হন, যারা বলে যা করে না।" - (সূরা আস-সফ, আয়াত ২)
সুতরাং, হজ যেন আত্মশুদ্ধির যাত্রা হয়ে থেকে না যায়
কেবল স্মৃতির পাতায়। বরং তা হোক এক বাস্তব জীবনব্যবস্থার সূচনা, যাতে সমাজও পরিবর্তিত হয়, পরিবারও সৎ পথে চলে, আর আমরা সত্যিকার অর্থে মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করি।
হজের শিক্ষা হোক আমাদের প্রতিদিনের পথনির্দেশ। কেবল হজ পালন করাই নয়, সেই হজের আলোয় আলোকিত জীবন গড়াই হোক মূল লক্ষ্য।