গ্যাসলাইটিংয়ের নীরব আগ্রাসন

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
একটা সময় ছিল, যখন নির্যাতনের প্রমাণ মানেই ছিল দেহে আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু এখন মানসিক যন্ত্রণার কিছু ধরণ এতটাই সূক্ষ্ম ও কৌশলী যে, বাইরের দুনিয়া কিছুই টের পায় না—এবং ঠিক এমনই এক নির্যাতনের কৌশলের নাম গ্যাসলাইটিং।
গ্যাসলাইটিং শব্দটি এসেছে ১৯৩৮ সালের ব্রিটিশ থিয়েটার নাটক 'Gas Light' থেকে, যেখানে এক স্বামী তার স্ত্রীর বাস্তব উপলব্ধিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ধীরে ধীরে তাকে মানসিকভাবে অস্থির করে তোলে। নাটকের এই উপমাটি আজকের বাস্তব জীবনে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
গ্যাসলাইটিং কী?
গ্যাসলাইটিং হলো একধরনের মানসিক এবং আবেগগত নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আরেকজনকে নিজের বোধ, স্মৃতি, যুক্তি এবং সত্য উপলব্ধি নিয়ে সন্দেহ করতে বাধ্য করে। এটি দীর্ঘ সময় ধরে চললে ভুক্তভোগীর মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে।
এটি কেবল মানসিক নির্যাতন নয়—এটি একপ্রকার মানসিক প্রোগ্রামিং, যেখানে 'রিয়েলিটি' শব্দটাই নিজের মধ্যে বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে।
মস্তিষ্কের উপর প্রভাব -
মানব মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা নিয়ন্ত্রণ করে ভয় ও আবেগ, আর হিপোক্যাম্পাস স্মৃতি সংরক্ষণের কেন্দ্র। গ্যাসলাইটিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে এই দুই অংশের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। বিশেষ করে, ক্রমাগত অবমূল্যায়ন এবং আত্মবিশ্বাসের অবক্ষয়ে কর্টিসল (stress hormone) নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা মানসিক চাপ, স্মৃতিভ্রংশ এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নিউরোসাইকোলজির একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে, ক্রমাগত গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার ব্যক্তিরা "cognitive dissonance" (মনের দ্বন্দ্ব) এবং "learned helplessness" (শিখে নেয়া অসহায়ত্ব) অবস্থায় চলে যায়, যার ফলে তারা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
গ্যাসলাইটিংয়ের চিহ্ন কীভাবে চিনবেন?
১. বাস্তবতাকে অস্বীকার করা: আপনার বলা কথা বা ঘটনার অস্তিত্বই অস্বীকার করা হয়। যেমন: "তুমি এটা বলোইনি", "তুমি ভুল বুঝছো।"
২. অতিরিক্ত ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য: "তোমার মনে সবসময় কিছু একটা ভুল থাকে।"
৩. আপনাকে মানসিকভাবে অস্থির প্রমাণ করা: "তুমি খুব সেন্সিটিভ", "তোমার সমস্যা সব জায়গায়!"
৪. একা করে ফেলা ও আত্মসম্মান ভাঙা: আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের বিরুদ্ধে মনোভাব তৈরি করা হয় যেন আপনি একা হয়ে পড়েন।
কারা কারা করে গ্যাসলাইটিং?
গ্যাসলাইটার হতে পারে—
⇨জীবনসঙ্গী
⇨পরিবার/অভিভাবক
⇨বস বা সহকর্মী
⇨বন্ধু
তারা সাধারণত খুব আত্মবিশ্বাসী, ক্যারিসম্যাটিক এবং নিজের আচরণকে যুক্তিযুক্তভাবে ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম। তাঁরা জানে কাকে কীভাবে ভাঙতে হয়—এটাই তাদের মানসিক অস্ত্র।
প্রতিরোধ ও মুক্তির পথ
✔ নিজের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন: কেউ যদি বারবার আপনাকে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে সন্দেহ করায়, তবে নিজেকে প্রশ্ন করুন—আমি কি সত্যিই ভুল? নাকি আমাকে ভুল বোঝানো হচ্ছে?
✔ রেকর্ড রাখুন: আলোচনার সময়, মেসেজ বা ইমেইল ধরে রাখুন। এগুলো সত্যতা যাচাই করতে সাহায্য করে।
✔ বিশ্বস্ত মানুষের সঙ্গে আলাপ করুন: যাদের আপনি বিশ্বাস করেন, তাদের সঙ্গে নিয়মিত মন খুলে কথা বলুন।
✔ সাহায্য নিতে ভয় পাবেন না: থেরাপি বা কাউন্সেলিং কোনো দুর্বলতা নয়, বরং আত্মরক্ষার উপায়।
✔ No বলতে শিখুন: নিজের মানসিক সীমানা স্পষ্ট করে দিন। দোষ আপনার নয়।
✪✪ সমাজের জন্য বার্তা-
গ্যাসলাইটিং মানসিক নিপীড়নের এক ভয়াবহ রূপ। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো—এটি প্রায় সবক্ষেত্রে নীরব থাকে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা, সচেতনতা এবং সমর্থনব্যবস্থা।
এটি কেবল একজন ব্যক্তির সমস্যা নয়—এটি এক সামাজিক ব্যাধি, যা সম্পর্কের ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়।
আপনার অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, অনুভব—সবই সত্যি, যদি আপনি নিজে তা অনুভব করেন। কেউ যদি আপনার বাস্তবতাকে মুছে ফেলতে চায়, সেটাই সতর্ক হবার সময়।
গ্যাসলাইটিং-এর শিকার না হয়ে, আপনি নিজেই হয়ে উঠুন নিজের সত্যর রক্ষাকর্তা।