কুরবানির মাংস খাওয়ার পর হজমজনিত জটিলতা: কীভাবে এড়াবেন এই বিপজ্জনক পরিণতি?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ঈদুল আজহার অন্যতম প্রতীক কুরবানি—আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু উৎসর্গ। আর এই কুরবানির অন্যতম আনন্দের অংশ মাংস খাওয়া। কিন্তু অতিরিক্ত গরু বা খাসির মাংস খাওয়ার কারণে ঈদের আনন্দ রূপ নিতে পারে শারীরিক কষ্টে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতি বছর কুরবানির ঈদের পর কয়েক হাজার মানুষ হজমের সমস্যা, অ্যাসিডিটি, পেট ফাঁপা, গ্যাস্ট্রিক এবং পেট ব্যথার কারণে ভর্তি হন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটু সচেতনতা ও পরিমিতিবোধই এই জটিলতা এড়াতে পারে।
অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার পরিপাকগত প্রভাব
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টদের মতে,
"লাল মাংস—বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংসে চর্বি এবং প্রোটিনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় তা হজম হতে সময় নেয়। অতিরিক্ত খেলে পাচনতন্ত্র অতিরিক্ত কাজ করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে বদহজম, অ্যাসিড রিফ্লাক্স, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, এমনকি আলসারও হতে পারে।"
যাদের আগে থেকেই গ্যাস্ট্রিক, লিভার সমস্যা, বা হজম দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে এসব ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি: পরিমিতি ও ভারসাম্য
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাহ অনুসারে, খাবারে পরিমিতিবোধ অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেছেন:
"মানুষের পেটের জন্য যথেষ্ট হল তিন ভাগের এক ভাগ খাবার, এক ভাগ পানি, এবং এক ভাগ শ্বাস নেওয়ার জন্য ফাঁকা রাখা।" — (তিরমিজি)
অর্থাৎ, অতিরিক্ত খাওয়া ইসলামিক দৃষ্টিতে উচিৎ নয় এবং এটি শরীরের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
যাঁদের জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন
➤ ডায়াবেটিস রোগী:
– লাল মাংসে থাকা চর্বি ইনসুলিন কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। – ফ্রাই, বিরিয়ানি বা ঝাল মাংসের পরিবর্তে সিদ্ধ বা হালকা ঝোল খেতে বলা হয়। – একসঙ্গে ভাত ও মাংস বেশি খাওয়া এড়াতে হবে।
➤ উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগীরা:
– মাংসে উচ্চ মাত্রায় স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং সোডিয়াম থাকায় তা রক্তচাপ বাড়াতে পারে। – লবণ ও তেল কমিয়ে, সিদ্ধ অথবা গ্রিলড রেসিপি অনুসরণ করা ভালো।
➤ বৃদ্ধ, শিশু ও কিডনি রোগীরা:
– হজমশক্তি দুর্বল থাকায় অতিরিক্ত মাংস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য, অ্যাসিডিটি ও ডিহাইড্রেশন হতে পারে। – হাড়ের ঝোল বা পাতলা মাংসের তরকারি নিরাপদ বিকল্প।
হজমে সহায়ক খাবার ও পানীয়
✔ পানি: ঈদের দিনে প্রচুর পানি পান করা আবশ্যক। লাল মাংস দেহে ইউরিক অ্যাসিড ও মেটাবলাইট বাড়ায়—যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর। অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি প্রতিদিন পান করুন।
✔ টকদই: প্রোবায়োটিক উপাদানে সমৃদ্ধ, যা পাচনতন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে।
✔ আদা-লেবুর রস: হালকা গরম পানিতে লেবুর রস ও এক চিমটি আদা হজম শক্তি বাড়ায় ও গ্যাস কমায়।
✔ পুদিনা ও ধনে পাতা: সালাদে ব্যবহার করুন। এগুলো হজমে সাহায্য করে এবং বমিভাব দূর করে।
✔ সবজি: আঁশযুক্ত খাবার যেমন লাউ, করলা, পালংশাক ও ঢেঁড়স মাংসের চর্বি ভাঙাতে সহায়ক।
✔ জিরা ও মৌরি চা: হজম সহজ করে ও অ্যাসিডিটি কমায়।
যে লক্ষণগুলো দেখলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে-
⇨বমি বা বমিভাব
⇨অতিরিক্ত বুক জ্বালা
⇨পেটে তীব্র ব্যথা
⇨টানা পাতলা পায়খানা
⇨মুখে অরুচি ও দুর্বলতা
⇨গ্যাস্ট্রিকের ওষুধেও উন্নতি না হওয়া
পরিমিত খাবারের ইসলামিক গুরুত্ব
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
"তোমরা খাও এবং পান কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।" — (সূরা আল-আরাফ, আয়াত ৩১)
অর্থাৎ, খাদ্যে অপচয় না করে ভারসাম্য বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা শরীরের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
কিছু স্বাস্থ্যকর পরামর্শ সংক্ষেপে
⇨ একসঙ্গে তিন বেলা মাংস না খেয়ে এক বেলা রাখুন ⇨ মাংস খাওয়ার পর হালকা হাঁটাহাঁটি করুন
⇨ সকালের নাশতায় শাকসবজি বা ফল রাখুন
⇨ অন্তত দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে পরবর্তী খাবার গ্রহণ করুন
⇨ রান্নায় দুধ, টকদই, পেঁপে, আদা ও জিরার ব্যবহার বাড়ান
ঈদে কুরবানির মাংস খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করুন, তবে পরিমিতভাবে এবং শরীরের কথা বিবেচনা করে। ইসলামিক শিক্ষা ও আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান উভয়ই পরিমিতি, ভারসাম্য ও সচেতন খাদ্যাভ্যাসের উপর জোর দেয়। এভাবেই ঈদ হবে সত্যিকারের আনন্দ ও সুস্থতার উৎসব।
এই ঈদে হোক নিয়ন্ত্রিত ও সচেতন খাদ্যাভ্যাসের মধ্য দিয়ে শরীর ও রূহের প্রশান্তি অর্জনের সঠিক প্রয়াস। ঈদ হোক আনন্দ ও সুস্থতার মিলনমেলা।