সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির রহস্য বৃহস্পতির চুম্বকীয় ক্ষেত্র, বায়ুমণ্ডল ও আভ্যন্তরীণ গঠন

সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির রহস্য বৃহস্পতির চুম্বকীয় ক্ষেত্র, বায়ুমণ্ডল ও আভ্যন্তরীণ গঠন
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

সৌরজগতের পঞ্চম গ্রহ, বৃহস্পতি-এটি শুধু সবচেয়ে বড় গ্রহই নয়, বরং রহস্য ও শক্তির এক অসীম ভাণ্ডার। একদিকে বিশাল চৌম্বকক্ষেত্র, অন্যদিকে ভয়ানক বায়ুমণ্ডল ও গভীর অভ্যন্তরীণ গঠন-এই সব কিছু মিলিয়ে বৃহস্পতি যেন এক মহাজাগতিক ল্যাবরেটরি। সাম্প্রতিক মহাকাশ অনুসন্ধান, উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ ও তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আরও গভীরভাবে বুঝতে পারছেন, এই গ্যাসীয় দৈত্য আসলে কতটা জটিল ও বিস্ময়কর।

বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্র সৌরজগতের সবচেয়ে বড় চৌম্বকীয় শক্তি-  বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্র (Magnetosphere) পৃথিবীর তুলনায় ২০,০০০ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং এটি এক বিশাল বলয়ে পরিণত হয়ে রয়েছে। এর বিস্তার এতটাই বৃহৎ যে, এটি সূর্য থেকে আসা সৌর কণাকে বিপথে ঠেলে দেয় কয়েক মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে।

এর চৌম্বকীয় রেখার প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে এটি বৃহস্পতির চাঁদ গ্যানিমিডের চৌম্বক ক্ষেত্রকেও প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে। উল্লেখযোগ্যভাবে, গ্যানিমিড সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যার নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে-এটি বৃহস্পতির কারণে আরও গতিশীল রূপে ধরা দেয়।

জুনো (Juno) মহাকাশযানের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎস শুধুই চুম্বক নয়, বরং এক অভ্যন্তরীণ 'ধাতব হাইড্রোজেন' স্তর যা প্রচণ্ড চাপে ইলেকট্রন সঞ্চালিত করে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে।
 

ভয়ংকর বায়ুমণ্ডল: বজ্রপাত, ঝড় আর গ্যাসের সমুদ্র

বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডল এক রহস্যময় ও ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। প্রধান গ্যাস উপাদান হাইড্রোজেন (H₂) ও হিলিয়াম (He), তবে এই দুই গ্যাসের উপরে ভেসে থাকা মেঘপুঞ্জগুলোতে রয়েছে অ্যামোনিয়া, সালফার ও পানি বাষ্প। উচ্চস্তরে, শত শত কিলোমিটার জুড়ে চলে বজ্রপাত ও বায়ুবৈদ্যুতিক কার্যক্রম, যা পৃথিবীর যেকোনো বজ্রপাতের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

"গ্রেট রেড স্পট" নামে পরিচিত বিশালাকার ঘূর্ণিঝড়টি অন্তত ৩৫০ বছর ধরে সক্রিয় এবং এটি এতটাই বড় যে, তিনটি পৃথিবী একসঙ্গে এতে স্থান পেত। এই ঝড় প্রতি ঘণ্টায় ৪৩০ কিমি বেগে ঘুরছে এবং বিজ্ঞানীদের মতে এটি বৃহস্পতির আবহাওয়ায় শক্তি সঞ্চয়ের এক বিরল নিদর্শন।

এছাড়া, বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন ঝড়, যেগুলো "বেল্ট" ও "জোন" নামে পরিচিত সাদা-বাদামি ব্যান্ডে ছড়িয়ে থাকে। এই মেঘবাহিত স্তরগুলো গতি, তাপমাত্রা ও গ্যাসীয় উপাদান অনুযায়ী একে অপরের বিপরীতে ঘোরে, ফলে তৈরি হয় জটিল আবহাওয়া প্যাটার্ন।

 

অভ্যন্তরীণ গঠন- 

বৃহস্পতি দেখতে যতটা গ্যাসীয়, ভিতরে ততটাই ঘন ও শক্তিশালী। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর কেন্দ্রে একটি কঠিন বা আধা-কঠিন নিউক্লিয়াস থাকতে পারে, যার উপর চাপ প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বার পৃথিবীর বায়ুচাপের সমান।

কেন্দ্রের চারপাশে ঘন হাইড্রোজেন ধাপে ধাপে রূপান্তরিত হয়েছে 'ধাতব হাইড্রোজেনে', যা ইলেকট্রন মুক্তভাবে প্রবাহিত করতে সক্ষম এবং এটি বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্রের মূল জ্বালানি। এই রূপান্তর প্রক্রিয়া কেবল উচ্চ চাপ নয়, অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা (২০,০০০°C-এর বেশি) দাবি করে।
 

বৃহস্পতি ও গবেষণার ভবিষ্যৎ-

বৃহস্পতিকে ঘিরে গবেষণার গতি আরও বাড়ছে। NASA-এর "Juno" মিশনের পাশাপাশি ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA)-এর JUICE (Jupiter Icy Moons Explorer) মিশন ২০২৪ সালে বৃহস্পতির পথে যাত্রা করেছে, যা ২০২৯ নাগাদ বৃহস্পতির চাঁদগুলোর কাছাকাছি পৌঁছাবে। এই মিশন বৃহস্পতির চাঁদগুলিতে সম্ভাব্য তরল পানির অস্তিত্ব এবং সেখানে প্রাণের উপযোগিতা যাচাই করবে।

বৃহস্পতির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে আমরা শুধু এই গ্রহকেই নয়, বরং অন্যান্য গ্যাসীয় দৈত্য গ্রহ (যেমন: স্যাটার্ন, ইউরেনাস, নেপচুন) ও এমনকি এক্সোপ্ল্যানেট নিয়েও আরও স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি।
 

বৃহস্পতি হলো সৌরজগতের এক চলমান শক্তিঘর-যেখানে পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং মহাকাশবিজ্ঞানের অজস্র সমীকরণ একত্রে কাজ করছে। এর প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে আছে নতুন নতুন প্রশ্ন, যেগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে মানব সভ্যতার জ্ঞানও আরও প্রসারিত হয়।


সম্পর্কিত নিউজ