গ্রীষ্মে নীরব শত্রু হয়ে উঠছে হিট এক্সহসশন – সময়মতো সতর্ক না হলে ঝুঁকি মারাত্মক

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
প্রচণ্ড দাবদাহে নগর থেকে গ্রাম-বাংলাদেশজুড়ে মানুষের জীবনধারা বদলে যাচ্ছে। জুনের শুরুতেই ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁইছুঁই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে দেশের একাধিক অঞ্চলে। এমন অবস্থায় "হিট এক্সহসশন" বা অতিরিক্ত গরমজনিত শারীরিক অবসাদ ক্রমেই জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে প্রকট হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন-এটি শুধু অস্বস্তির বিষয় নয়, সময়মতো চিকিৎসা না পেলে এটি হিট স্ট্রোকে রূপ নিতে পারে, যার ফল হতে পারে অঙ্গ বিকল হওয়া কিংবা মৃত্যু পর্যন্ত।
হিট এক্সহসশন কী?
শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যখন ব্যর্থ হয়, তখন শুরু হয় হিট এক্সহসশন। আমাদের দেহ ঘামের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যখন আবহাওয়া অতিরিক্ত গরম ও আর্দ্র হয়, তখন ঘাম ঠিকভাবে বাষ্প হয়ে যেতে পারে না। এতে শরীর দ্রুত গরম হয়ে ওঠে, আর তাতেই বিপদ শুরু।
বিজ্ঞান বলছে, যখন পরিবেশের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায় এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ৬০-৭০ শতাংশে পৌঁছায়, তখন শরীরের স্বাভাবিক কুলিং মেকানিজম ভেঙে পড়ে।
ঝুঁকিতে কারা??
১। শিশু ও বয়স্করা: যাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দুর্বল
২। মুক্ত শ্রমিকরা: নির্মাণ, কৃষি ও রিকশাচালকরা রোদে কাজ করেন দীর্ঘ সময়
৩। যারা দৈনিক বাইরে চলাফেরা করেন: শিক্ষার্থী, পুলিশ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী
৪। দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্তরা: বিশেষত হার্ট ডিজিজ, ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগে ভোগা ব্যক্তি
৫। অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন গ্রহণকারীরা: এগুলো শরীরে পানি কমিয়ে দেয়
লক্ষণসমূহ-
হিট এক্সহসশনের প্রাথমিক লক্ষণগুলোকে অবহেলা করা বিপজ্জনক হতে পারে। লক্ষণগুলো হলো:
১। অতিরিক্ত ঘাম
২। মাথা ঘোরা বা অস্বাভাবিক দুর্বলতা
৩। বমিভাব বা বমি
৪। মাথাব্যথা
৫। ত্বক ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে ও ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
৬। দ্রুত ও দুর্বল হৃদস্পন্দন
৭। পেশিতে ক্র্যাম্প
৮। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (ফেইন্টিং)
উল্লেখ্য, হিট এক্সহসশন হিট স্ট্রোকে রূপ নিলে শারীরিক তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। এ সময় মস্তিষ্কসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কী করবেন এই অবস্থায়??
হিট এক্সহসশন দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে:
১। আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে নিয়ে যান
২। শরীরের কাপড় হালকা করে দিন
৩। শরীর ঠান্ডা করার জন্য ভেজা তোয়ালে, স্পঞ্জ বা পানির ঝাপটা ব্যবহার করুন
৪। ইলেক্ট্রোলাইট বা স্যালাইন পানি খাওয়ান
৫। অবস্থার উন্নতি না হলে দ্রুত চিকিৎসা নিন
হিট এক্সহসশন বনাম হিট স্ট্রোক- হিট এক্সহসশন সতর্কবার্তা, আর হিট স্ট্রোক হলো জরুরি অবস্থা। প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেই ব্যবস্থা না নিলে বিপদ আসন্ন। গরমের দিনে নিজেকে এবং আশেপাশের মানুষকে সচেতন রাখাই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ।
(Heat Exhaustion vs Heat Stroke)
১. শরীরের তাপমাত্রা:
হিট এক্সহসশন: সাধারণত ৩৭.৫°C থেকে ৪০°C পর্যন্ত
হিট স্ট্রোক: ৪০°C বা তার বেশি
২. ঘাম:
হিট এক্সহসশন: অতিরিক্ত ঘাম হয়
হিট স্ট্রোক: ঘাম একেবারে কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়
৩. ত্বকের অবস্থা:
হিট এক্সহসশন: ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে, ফ্যাকাশে
হিট স্ট্রোক: গরম, শুকনো এবং লালচে
৪. সচেতনতা ও মানসিক অবস্থা:
হিট এক্সহসশন: মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, ক্লান্তি, বমিভাব
হিট স্ট্রোক: বিভ্রান্তি, খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
৫. হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ:
হিট এক্সহসশন: দ্রুত ও দুর্বল হৃদস্পন্দন
হিট স্ট্রোক: দ্রুত হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ওঠানামা করে
৬. প্রতিক্রিয়া বা চিকিৎসায় উন্নতি:
হিট এক্সহসশন: বিশ্রাম, পানি, ছায়া—এতে অবস্থার উন্নতি হয়
হিট স্ট্রোক: ঘরোয়া চিকিৎসা যথেষ্ট নয়, হাসপাতালে ভর্তি জরুরি
৭. সময়ক্ষেপণ করলে ফলাফল:
হিট এক্সহসশন: অবহেলা করলে হিট স্ট্রোকে রূপ নিতে পারে
হিট স্ট্রোক: সময়মতো চিকিৎসা না পেলে অঙ্গ বিকল, এমনকি মৃত্যু হতে পারে
প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা
১। প্রতিদিন অন্তত ৩-৪ লিটার পানি পান করুন
২। প্রয়োজনে ওআরএস বা লবণ-চিনির পানি গ্রহণ করুন
৩। সরাসরি রোদে যাওয়ার আগে সান প্রটেকশন, ছাতা, হ্যাট ব্যবহার করুন
৪। দিনের সবচেয়ে গরম সময়ে (দুপুর ১২টা–৩টা) ঘরে থাকুন
৫। হালকা, ঢিলেঢালা ও পাতলা কাপড় পরিধান করুন
ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল পরিহার করুন
পরিবর্তিত জলবায়ুর যুগে গ্রীষ্ম শুধু দীর্ঘ নয়, আরও ভয়ানক। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিট এক্সহসশনকে আর হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। সচেতনতা, সময়মতো প্রতিকার এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামই হতে পারে এই ভয়ংকর শারীরিক অবসাদ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ।
এই গ্রীষ্মে নিরাপদ থাকুন-তাপ নয়, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিন।