উন্নত জাতি গঠনে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিক্ষার মডেল-বাংলাদেশ কি অনুসরণ করতে পারে?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
"শিক্ষা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, তা মনন গঠনের মাধ্যম"-এই ধারণা বাস্তবে রূপ দিয়েছে যে অঞ্চলটি, সেটি হলো স্ক্যান্ডিনেভিয়া। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন-এই তিনটি দেশ বিশ্বে উন্নতমানের শিক্ষা ও মানবিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা এখন এক আন্তর্জাতিক রোল মডেল। প্রশ্ন হলো-বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ কি এই মডেল থেকে কার্যকর কিছু নিতে পারে?
➤ ফিনল্যান্ড: 'No Homework, No Pressure, Still the Best' মডেল
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক গবেষণায় ধারাবাহিকভাবে সেরা অবস্থানে। মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
⇨ কোনো জাতীয় পরীক্ষা নেই (প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে); মূল্যায়ন হয় শিক্ষক পর্যায়ে কৌশলগতভাবে।
⇨ শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা: শিক্ষক হতে হলে মাস্টার্স ডিগ্রি বাধ্যতামূলক। শিক্ষক নিয়োগে প্রতিযোগিতা ডাক্তার বা প্রকৌশলীর সমপর্যায়ের।
⇨ শিক্ষা মানেই গবেষণাভিত্তিক শেখা: এখানে শিশুরা 'কেন' এবং 'কীভাবে' জানতে চায়, মুখস্থ করে না।
⇨ ফিনল্যান্ডে ৯ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো বাধ্যতামূলক পরীক্ষা নেই। গবেষণা বলছে, এই মডেলেই শিশুদের সামাজিক ও জ্ঞানগত দক্ষতা বেশি বিকশিত হয়।
নরওয়ে ও সুইডেন: প্রযুক্তিনির্ভর, শিশুবান্ধব ও মানবিক পাঠদান
⇨ নরওয়ে ও সুইডেনের ক্লাসরুমগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক খুবই মানবিক ও সমানাধিকারভিত্তিক।
⇨ "Flexible Learning Time" ও "Project-Based Learning" এখানে নিয়মিত পদ্ধতি।
⇨ শিক্ষার্থীদের শেখার গতি অনুযায়ী পাঠদান হয়; মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সংবেদনশীলতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়।
⇨ ডিজিটাল প্রযুক্তি পাঠ্যক্রমে একীভূত।
⇨ করোনাকালীন অনলাইন ট্রানজিশনে তাদের প্রস্তুতি ছিল আদর্শ।
⇨ সুইডেন সরকার ২০২0 সালের পর থেকে "Digital Literacy" প্রাথমিক স্তরে বাধ্যতামূলক করেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষার প্রবাহে শৃঙ্খলা আছে, গভীরতা কম -
বাংলাদেশে শিক্ষা বর্তমানে প্রচুর উন্নয়ন দেখাচ্ছে-শিক্ষার হার, স্কুলে ভর্তি, নারীশিক্ষায় প্রবেশ ইত্যাদি। কিন্তু গুণগত মানে এখনো রয়েছে জটিল সব বাধা: মুখস্থনির্ভর পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষাকেন্দ্রিক মানদণ্ড।
⇨ এক শিক্ষক বহু ছাত্র: প্রাথমিক পর্যায়ে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ৫০+ শিক্ষার্থীর হার সাধারণ।
⇨ মানসিক স্বাস্থ্য ও সৃজনশীলতা উপেক্ষিত।
⇨ টেক-ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সীমাবদ্ধতা: শহরের বাইরে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যত অনুপস্থিত।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার হার ২০ শতাংশের নিচে, যেখানে ফিনল্যান্ডে তা ৭০ শতাংশের বেশি।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মডেল থেকে বাংলাদেশ কী শিখতে পারে?
✔ শিক্ষক তৈরির মডেল: স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় শিক্ষকতা একটি গবেষণাভিত্তিক ও উচ্চ মর্যাদার পেশা। বাংলাদেশেও জাতীয় প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের আধুনিকায়ন করে মাস্টার্স-লেভেল প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা যায়।
✔ সৃজনশীল পাঠ্যক্রম: প্রচলিত পাঠ্যক্রমের বাইরে 'প্রকল্প-ভিত্তিক শিক্ষা', 'সমস্যা সমাধান ভিত্তিক' ও 'সহযোগিতামূলক শেখা' অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি।
✔ প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি: সরকারের উদ্যোগে ডিজিটাল ক্লাসরুম প্রকল্প থাকলেও তা এখনও সীমিত। 'Digital School Box' প্রকল্পের মতো কার্যকরী মডেল তৈরি করা সম্ভব।
✔ মূল্যায়নের পদ্ধতি পুনর্বিন্যাস: প্রশ্নপত্রে বিশ্লেষণধর্মী ও বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন সংযোজন এবং বার্ষিক পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে 'ধাপে ধাপে' মূল্যায়ন কার্যকর করতে হবে।
✔ মানসিক স্বাস্থ্য ও খেলাধুলা: স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিশুদের জন্য স্কুলের অংশ হিসেবে রয়েছে 'মাইন্ডফুলনেস সেশন', 'ইমোশনাল লিটারেসি' ও দৈনিক শরীরচর্চা। বাংলাদেশের পাঠ্যসূচিতে এই উপাদানগুলো যুক্ত করা অপরিহার্য।
শুধু স্কোর নয়-একটি শিশু কতটা চিন্তাশীল, মানবিক ও সমন্বিতভাবে বেড়ে উঠছে, সেটাই আধুনিক শিক্ষার মাপকাঠি। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
বাংলাদেশ যদি নিজের বাস্তবতা অনুযায়ী সেই পথের দিকনির্দেশ গ্রহণ করে, তবে একটি উদ্ভাবনী, মানবিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন আর দূরবর্তী থাকবে না।