নিজের বিশ্বাসকেই বারবার ঠিক প্রমাণ করতে চাওয়া - 'Confirmation Bias'কীভাবে আমাদের সমাজ ও মানসিকতায় দখল নেয়?

নিজের বিশ্বাসকেই বারবার ঠিক প্রমাণ করতে চাওয়া - 'Confirmation Bias'কীভাবে আমাদের সমাজ ও মানসিকতায়  দখল নেয়?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একই খবর দেখেও দুইজন মানুষ দুই রকম ব্যাখ্যা দেয়। কেউ বলবে, "এই খবর প্রমাণ করে আমি ঠিক ছিলাম।", আবার কেউ বলবে, "দেখেছো, আবার প্রমাণ হয়ে গেল ওরা ভুল!" এই দ্বৈত প্রতিক্রিয়ার মূলেই রয়েছে একটি শক্তিশালী কিন্তু প্রায় অদৃশ্য মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা — 'Confirmation Bias', অর্থাৎ নিজের বিশ্বাসকে প্রমাণ করতে চাওয়ার মানসিকতা।

কী এই 'Confirmation Bias'?

মানুষের মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো নিজের আগে থেকে গড়ে ওঠা বিশ্বাস, ধারণা বা মতামতকে সমর্থন করে এমন তথ্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং তার বিপরীত তথ্যকে এড়িয়ে চলা। মনোবিজ্ঞানীরা এটিকে বলেন "selective information processing", যার ফলে আমরা প্রায়ই সত্য থেকে বিচ্যুত হই, কিন্তু সেটা টেরও পাই না।
 

উদাহরণস্বরূপ:

আপনি যদি বিশ্বাস করেন হোমিওপ্যাথি কার্যকর, তাহলে আপনি কেবল সেই গবেষণা বা অভিজ্ঞতা খুঁজবেন, যা এটাকে সমর্থন করে, বিপরীত তথ্য দেখলে আপনি হয়তো সেটাকে গুরুত্বই দেবেন না।

রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, দুই পক্ষ একই ঘটনার উপর দুই রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করায় — এবং দু'জনেই বিশ্বাস করে তাদের ব্যাখ্যাই একমাত্র সত্য।
 

'Confirmation Bias' প্রথম আলোচনায় আসে ১৯৬০-এর দশকে মনোবিজ্ঞানী পিটার ওয়াসনের পরীক্ষার মাধ্যমে।

বিশ্বজুড়ে গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষ তথ্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন।

২০২৩ সালে একটি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ভুল সিদ্ধান্তের প্রায় ৭২% ক্ষেত্রে কোনো না কোনো ধরনের 'bias' যুক্ত ছিল।
 

মনস্তত্ত্ব বলছে কী?

স্নায়ুবিজ্ঞান অনুযায়ী, মানুষের মস্তিষ্ক এমনভাবে গঠিত যে, সেটি cognitive dissonance বা মানসিক অস্বস্তিকে এড়াতে চায়। যখন কোনো নতুন তথ্য আমাদের বিশ্বাসের বিপরীতে যায়, তখন তা মস্তিষ্কে অস্বস্তি তৈরি করে — ফলে আমরা এমন তথ্যকে অবচেতনভাবে এড়িয়ে যাই বা নাকচ করে দেই।

বিশ্বাসভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই ঝোঁক শিশু বয়স থেকেই তৈরি হয় না; বরং এটি সময়ের সঙ্গে, অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের প্রভাবে গড়ে ওঠে। 

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতামত যত বেশি শক্তিশালী হয়, তত বেশি মানুষ 'confirmation bias'-এর মধ্যে পড়ে।
 

ডিজিটাল যুগে এর প্রভাব আরও প্রবল- 

আজকের সময়ে এই প্রবণতা আরও জটিল আকার নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ও অ্যালগরিদমভিত্তিক কনটেন্ট ফিড এর কারণে। আপনি যদি একবার কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা তত্ত্ব নিয়ে কিছু পড়েন, ইউটিউব, ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) আপনাকে একই ধরণের কনটেন্ট দেখিয়ে যাবে - আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন না যে আপনি এক 'ডিজিটাল একঘেয়েমি'র মধ্যে আটকে পড়েছেন।

একে বলে Echo Chamber Effect - যেখানে আপনি কেবল নিজের মতের সমর্থনে কথা শুনছেন, ভিন্ন মত সেখানে প্রবেশই করতে পারছে না।
 

এর সামাজিক প্রভাব - 

- মতবিরোধ বৃদ্ধি: রাজনীতি বা সামাজিক ইস্যুতে ভিন্ন মতামতকে সহ্য করতে না পারার প্রবণতা বাড়ছে।

- ভুল সিদ্ধান্ত: চিকিৎসা, আইন, ব্যবসা কিংবা ব্যক্তিগত জীবনেও ভুল সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ এই মানসিক পক্ষপাত।

- মিথ্যা তথ্য ছড়ানো: যখন কেউ আগে থেকেই বিশ্বাস করে কোনও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সত্যি, তখন তারা যাচাই না করেই তথ্য শেয়ার করে, যা misinformation ছড়িয়ে দেয়।

 

কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?

এই প্রবণতা পুরোপুরি দূর করা অসম্ভব হলেও কিছু কার্যকর কৌশল রয়েছে:

- নিজের বিশ্বাসকে প্রশ্ন করা: "আমি যা ভাবছি, সেটাই কি একমাত্র সত্য?" — এই প্রশ্ন নিজেকে করুন।

- ভিন্নমত শুনুন ও জানুন: ইচ্ছা করে এমন লেখক, ভিডিও বা বক্তব্য দেখুন যা আপনার মতের বিপরীত।

- তথ্য যাচাই করুন: শুধু মত নয়, তথ্য যাচাই করুন বিশ্বাসের আগে।

- অ্যালগরিদম ভাঙুন: নিজের ফিডে বিভিন্ন উৎসের কনটেন্ট এনেই একঘেয়েমি কাটানো সম্ভব।
 

'Confirmation Bias' কোনো দুর্বলতার নাম নয়, এটি মানুষের মস্তিষ্কেরই একটি অভ্যাসগত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এই অভ্যাস যদি অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তবে সত্যের কাছ থেকে আমাদের দূরে নিয়ে যেতে পারে। তথ্যের এই যুগে বুদ্ধিমত্তা মানে কেবল জানার ক্ষমতা নয়, বরং নিজের বিশ্বাসকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারার সাহস।


সম্পর্কিত নিউজ