ছাত্র নয় শুধুই পাঠক - টিকে থাকার লড়াইয়ে পড়াশোনার পাশে পার্টটাইম পেশা আজ বাস্তবতা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে বিকেল ৫টার দিকে দেখা মিলল কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর—একজন হাতে ফুড ডেলিভারির ব্যাগ, আরেকজন তাড়াহুড়ো করে ফ্রিল্যান্সিং ক্লাসে যাচ্ছেন। আজকের বাংলাদেশে এটি আর নতুন কোনো দৃশ্য নয়। শিক্ষার পাশাপাশি কাজ করা যেন এক সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা, যাকে পাশ কাটানো কঠিন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী খণ্ডকালীন কাজের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষা, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং ভবিষ্যতের দক্ষতা অর্জন—এই তিন মূল চাহিদার তাগিদে আজ ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই হয়ে উঠছেন 'ওয়ার্কিং স্টুডেন্ট'।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের (BBS) ২০২৩ সালের একটি তথ্যে দেখা যায়, দেশের শহরাঞ্চলে ১৮-২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের অন্তত ২২ শতাংশ কোনো না কোনো রকম খণ্ডকালীন কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার খেলা নয়—এটি আমাদের ছাত্রজীবনের একটা পরিবর্তিত বাস্তবতাকে তুলে ধরে।
কেন এই কাজের প্রবণতা বাড়ছে?
বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকটি স্পষ্ট কারণ রয়েছে।
-প্রথমত, শিক্ষা খরচ বেড়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রাইভেট কোচিংয়ের পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার ব্যয়, যাতায়াত খরচ—সবকিছু মিলিয়ে অনেক শিক্ষার্থী ও তাঁদের পরিবার চাপের মধ্যে পড়েন।
-দ্বিতীয়ত, ক্যারিয়ার প্রস্তুতির জন্য অনেকেই এখন প্রফেশনাল স্কিল, সার্টিফিকেশন কোর্স বা অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হচ্ছেন—যা ফান্ড করতে গিয়েই
দরকার হয় বাড়তি আয়।
- তৃতীয়ত, বৈশ্বিক চাকরিবাজার এখন শুধু ডিগ্রির ওপর নির্ভর করে না। প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা, টিমওয়ার্ক, টাইম ম্যানেজমেন্ট—এসব স্কিল অর্জনের জন্য পার্টটাইম কাজ কার্যকর এক মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
কোন কোন খাতে শিক্ষার্থীরা যুক্ত হচ্ছেন?
অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং, কন্টেন্ট রাইটিং, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডেলিভারি সার্ভিস, রিটেইল সেলস, টিউশনি, কোচিং সেন্টার, রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ—এমন বহু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা খণ্ডকালীনভাবে কাজ করছেন।
বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর খাতে যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা ইউএক্স ডিজাইন—এসব ক্ষেত্রে আগ্রহ বাড়ছে। অনেকেই আবার ক্যাম্পাসের ভেতরেই ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরি কিংবা স্টুডেন্ট হেল্প ডেস্কে সময় দিচ্ছেন।
মানসিক চাপ নাকি বাস্তব শেখা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্টটাইম কাজ যদি ভারসাম্যপূর্ণ হয়, তাহলে এটি শিক্ষার্থীর জন্য উপকারী হতে পারে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত কাজ করলে শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ অনুষদের একজন অধ্যাপক বলছেন, "ছাত্রজীবনে কাজ করা এখন আর ব্যতিক্রম নয়, বরং এটিকে পরিকল্পিতভাবে সামলাতে পারলে এটি আত্মবিশ্বাস, সময় ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তবজ্ঞান গঠনে সহায়ক হয়।"
ভবিষ্যতের প্রস্তুতিপর্ব
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থী এখন নিজেই নিজের খরচ চালানোর চেষ্টা করছেন। এটি তাদের দায়িত্ববোধ, আত্মনির্ভরতা ও আত্মসম্মানের জায়গায় বড় ভূমিকা রাখে।
কেউ কেউ আবার শিক্ষাজীবন শেষ হবার আগেই নিজ উদ্যোগে স্টার্টআপ চালু করছেন বা একটি ছোট ব্যবসা গড়ে তুলছেন।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও 'ওয়ার্কিং স্টুডেন্ট' সংস্কৃতি স্বাভাবিক বিষয়। এখন বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেও সেই প্রবণতা দৃশ্যমান।
তবে পার্টটাইম কাজ যেন পড়াশোনাকে বাদ দিয়ে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি। কারণ পড়াশোনাই মূল ভিত, আর কাজ হতে পারে সেই ভিতকে আরো শক্ত করার মাধ্যম।
সংক্ষেপে বললে, শিক্ষা ও কর্মজীবনের এক সমন্বিত বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে আজকের ছাত্রসমাজ। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার নয়, বরং সঠিকভাবে ম্যানেজ করাই হতে পারে টিকে থাকার বিজ্ঞান।