বইয়ের পাতা খুললেই মস্তিষ্কে জেগে ওঠে সৃষ্টিশীলতার আগুন

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বই পড়া শুধু জ্ঞানের ভাণ্ডার বাড়ানোর মাধ্যম নয়, এটি মানুষের মস্তিষ্কের কাঠামোগত ও কার্যকরী পরিবর্তন ঘটিয়ে সৃজনশীলতা বৃদ্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানী গবেষণায় দেখা গেছে। ডিজিটাল যুগের এই দ্রুতগতির তথ্যজগতে, বইয়ের প্রভাব এতটাই গভীর যে তা দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে কিভাবে মস্তিষ্ক চিন্তা, কল্পনা ও উদ্ভাবনের ক্ষমতাকে আরও প্রসারিত করতে পারে।
মস্তিষ্কের সক্রিয়তা এবং বই পড়ার প্রভাব
বই পড়ার সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ একযোগে কাজ করে। নিউরোসায়েন্সের গবেষণায় দেখা গেছে, যখন আমরা একটি গল্প পড়ি, তখন default mode network (DMN) সক্রিয় হয়, যা চিন্তার অভ্যন্তরীণ প্রবাহ, আত্মপরিচয় ও কল্পনা তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত। এই DMN হলো সেই নেটওয়ার্ক যা মনোযোগ আমাদের ভিতরেকার চিন্তাভাবনার দিকে নিয়ে যায়, যেখানে নতুন ধারণা ও সৃজনশীল চিন্তার জন্ম হয়।
তাছাড়া, ভাষা প্রক্রিয়াকরণের জন্য Broca's area ও Wernicke's area শক্তিশালীভাবে কাজ করে, যা ভাষাগত দক্ষতা ও জটিল তথ্য বিশ্লেষণে সহায়তা করে। বই পড়ার মাধ্যমে এই ভাষা কেন্দ্রগুলো সক্রিয় থাকায় মানুষের ভাষাগত সৃজনশীলতা এবং সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
কল্পনা ও সমবেদনাশীলতার বিকাশ
গল্পের চরিত্র ও পরিস্থিতি নিয়ে পড়াশোনা মস্তিষ্কের mirror neuron system জাগ্রত করে। এই নিউরনগুলো অন্যের অনুভূতি ও ক্রিয়াকলাপ বুঝতে সাহায্য করে, ফলে পাঠক চরিত্রের ভাব, চিন্তা ও অনুভূতিকে স্বাভাবিক ভাবেই উপলব্ধি করতে পারে। এটি সৃজনশীলতার পাশাপাশি মানুষের সামাজিক বোধ ও সহানুভূতির উন্নতিতে সহায়ক।
বিকল্প চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা
বইয়ের বিভিন্ন ধারার পাঠ যেমন সাহিত্য, আত্মজীবনী, কল্পবিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি মস্তিষ্কের association cortex-কে উদ্দীপিত করে। এই অংশ নতুন তথ্য ও পুরনো অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে 'divergent thinking' বা বিকল্প চিন্তার বিকাশ ঘটায়। বিকল্প চিন্তা হল নতুন ও ভিন্ন ধরনের সমাধান বা আইডিয়া ভাবার ক্ষমতা, যা সৃজনশীলতার মূল ভিত্তি।
বই পড়ার অভ্যাস ও দীর্ঘমেয়াদী মস্তিষ্কের পরিবর্তন
দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস মস্তিষ্কের white matter বা স্নায়ুর সংযোগের ঘনত্ব বাড়ায়। স্নায়ু সংযোগের উন্নতি মানে তথ্য আদান-প্রদানে গতি ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি, যা দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
মস্তিষ্কের মানসিক নমনীয়তা বৃদ্ধি
মনোবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ, যারা প্রতিদিন অন্তত আধাঘন্টা বই পড়েন, তাদের cognitive flexibility বা মানসিক নমনীয়তা বেশি। মানসিক নমনীয়তা হল নতুন পরিস্থিতিতে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। এটি সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের জন্য অপরিহার্য, কারণ নতুন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই গুণ কাজ করে।
ডিজিটাল যুগে বইয়ের প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান সময়ে ডিজিটাল ডিভাইস থেকে তথ্য পাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তবে গবেষণা বলছে, ডিজিটাল স্ক্রীন থেকে পড়া মূলত scanning বা দ্রুত তথ্য গ্রহণের মাধ্যমে হয়, যেখানে বই পড়া গভীর মনোযোগ এবং বুদ্ধিমত্তার চর্চা করে। মুদ্রিত বই পড়ার মাধ্যমে মস্তিষ্ক আরও ধাপে ধাপে তথ্য বিশ্লেষণ করতে শেখে, যা গঠনমূলক চিন্তার জন্য অপরিহার্য।
শিক্ষা এবং পেশাগত জীবনে বইয়ের গুরুত্ব
অনেক উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বই পড়াকে সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার উন্নয়নের একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করছে। গবেষণা বলছে, বই পড়ার অভ্যাস পেশাগত জীবনে নতুন ধারণা ও উদ্ভাবন আনার ক্ষেত্রে সহায়ক। বিশেষ করে ডিজাইন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় বই পড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বই পড়া কেবল তথ্য গ্রহণ নয়, এটি একটি সমৃদ্ধ মানসিক যাত্রা যা মস্তিষ্কের কাঠামো ও কার্যপ্রণালীকে পরিবর্তন করে। বইয়ের প্রতিটি পাতা আমাদের চিন্তার পরিধি বাড়িয়ে তোলে, নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান, ভাষাগত দক্ষতা এবং সহানুভূতির বিকাশ-এসবের মূল চাবিকাঠি হতে পারে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস। ডিজিটাল যুগেও বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম; কারণ বইয়ের শব্দগুলো আমাদের মস্তিষ্কে স্থায়ী ছাপ ফেলে, যা জীবনের নানা ক্ষেত্রে সাফল্যের ভিত্তি গড়ে তোলে।
বইয়ের প্রতিটি শব্দ মস্তিষ্কে নতুন রাস্তা তৈরি করে, যা সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটায় এবং জীবনের নানা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা করে।