প্রচণ্ড গরমে মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে 'হিট স্ট্রোক'

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দেশজুড়ে তাপমাত্রার অভূতপূর্ব বৃদ্ধি, যেন এক ধরণের প্রাণঘাতী শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাপমাত্রা নয়, আমাদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও এখন দুর্বল। এমন সময় হঠাৎ মাথা ঘোরা, বুকে চাপ, অজ্ঞান হওয়া—এসবের পিছনে অন্যতম কারণ হয়ে উঠছে হিট স্ট্রোক, যা বিশ্বের বহু দেশে প্রতিবছর হাজারো মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।
হিট স্ট্রোকের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা: শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৬.৫-৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের দেহ ঘাম ও রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত তাপ ছাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তীব্র গরম এবং উচ্চ আর্দ্রতার কারণে যখন শরীর ঘাম দিয়ে নিজেকে ঠাণ্ডা করতে পারে না, তখন শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার উপরে। এসময় শরীরের কোষগুলো অক্সিজেন সংকটে পড়ে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো এই গরমে অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়ে, যার কারণে স্মৃতি হারানো, মস্তিষ্কে ফোস্কা, কেমিক্যাল ভারসাম্যের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
এমনকি হৃৎপিণ্ড ও কিডনির ফেইলিওরও হিট স্ট্রোকের একটি পরিণতি।
ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী এবং তাদের কারণ:
- বয়স্ক ব্যক্তিরা: বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায়।
- শিশুরা: তাদের ঘাম উৎপাদন ও তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ নয়।
- শ্রমজীবী ও বাইরের কর্মীরা: নির্মাণ শ্রমিক, কৃষক, রিকশা চালক যারা সরাসরি রোদে দীর্ঘ সময় থাকে।
-অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমকারী: গরমে ভারী কাজ শরীরকে অতিরিক্ত চাপ দেয়।
- সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা যুক্তরা: যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি যারা শারীরিক ভারসাম্য হারাতে বেশি প্রবণ।
হিট স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ:
⇨ শরীর থেকে ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া, ত্বক গরম ও শুষ্ক হয়ে ওঠা
⇨ প্রচণ্ড মাথা ঘোরা, বিভ্রান্তি বা মনোযোগের অভাব
⇨ দ্রুত বা অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দন
⇨ বমি বমি ভাব, দুর্বলতা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা
⇨ পেশীতে সংকোচন বা টান ধরা
হিট স্ট্রোকের প্রভাব ও ঝুঁকি: একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হিট স্ট্রোকের সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে গিয়ে নিউরোনাল মৃত্যুর হার বেড়ে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক অক্ষমতার কারণ হতে পারে।
এছাড়াও, দীর্ঘ সময়ের জন্য উচ্চ তাপমাত্রায় থাকা হার্ট অ্যাটাক ও কিডনি ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত চিকিৎসা না নিলে মৃত্যুর হারও বেড়ে যেতে পারে।
বিজ্ঞানের আলোকে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধের কৌশল:
১। হালকা, ঢিলেঢালা ও হালকা রঙের কাপড় ব্যবহার করুন যা তাপ শোষণ কমায়।
২। গরমের শীর্ষ সময় (সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা) বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৩। শরীরের পানির ঘাটতি প্রতিরোধে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন, কিন্তু ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলো ডিহাইড্রেশন বাড়ায়।
৪। কাজের মাঝে পর্যাপ্ত বিরতি নিন, ছায়ায় বিশ্রাম করুন।
৫। শীতল পানির স্প্রে বা ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর ঠাণ্ডা রাখুন।
৬। শিশুরা ও বৃদ্ধদের বিশেষ যত্ন নিন, বিশেষ করে যানবাহনে একা না রেখে ছায়াযুক্ত ও ঠাণ্ডা জায়গায় রাখুন।
জরুরি অবস্থায় করণীয়: যদি কারো শরীরে হিট স্ট্রোকের উপসর্গ দেখা দেয়-
- দ্রুত তাকে গরম থেকে দূরে সরান।
- শরীরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য ঠাণ্ডা পানির স্প্রে বা ভেজা তোয়ালে ব্যবহার করুন।
- দ্রুত ঠাণ্ডা পানি পান করান যদি সে সচেতন থাকে।
- তাত্ক্ষণিকভাবে হাসপাতালে নিয়ে যান, কারণ সময় নষ্ট করলে মস্তিষ্ক ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি অবস্থা অপরিবর্তনীয় হয়ে যেতে পারে।
গবেষণার আলোকে ভবিষ্যতের ঝুঁকি গ্লোবাল ওয়র্মিং ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মকাল এখন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এই পরিবর্তন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে চিহ্নিত হয়েছে।
আমাদের দেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের তাপপ্রবণ অঞ্চলে এই রোগের প্রভাব আরও বেশি।
গরমের আঘাতে বাঁচতে হলে আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা, সময়োপযোগী প্রস্তুতি ও সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। হিট স্ট্রোককে নির্ভয়ে মোকাবেলা করতে পারলে গরমের এই ভয়াবহ দিক থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই গরমকালে শুধু তাপমাত্রা কমানো নয়, শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণের জটিলতা বুঝে সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের সর্বোচ্চ প্রয়োজন।