ওসিডির বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা ও সামাজিক প্রতিফলন

ওসিডির বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা ও সামাজিক প্রতিফলন
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার বা ওসিডি এমন একটি মানসিক রোগ যা আজও অনেকের কাছে রহস্যময় এবং ভুল বোঝাবুঝির শিকার। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে এমন এক ধরনের অদৃশ্য যন্ত্রণা কাজ করে, যা তাকে চিন্তা এবং কাজের মাধ্যমে বারবার একই 'অবশ্যম্ভাবী' কাজ করতে বাধ্য করে। এই বাধ্যতামূলক আচরণগুলো (compulsions) আর পুনরাবৃত্তিমূলক চিন্তাগুলো (obsessions) রোগীর জীবনে গভীর অসুবিধা সৃষ্টি করে এবং তার মানসিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে।

ওসিডি কী এবং কেন হয়?

ওসিডি হল একটি নিউরোলজিক্যাল ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশের কার্যকারিতায় গড়ে ওঠে। মস্তিষ্কের cortico-striato-thalamo-cortical (CSTC) সার্কিট অত্যধিক সক্রিয় হলে ওসিডি লক্ষণগুলো দেখা দেয়। এর সঙ্গে জড়িত থাকে সেরোটোনিন এবং অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর ভারসাম্যের বিঘ্ন। জিনগত প্রভাব, শিশুকালে মানসিক আঘাত বা পরিবেশগত চাপও এই রোগের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
 

ওসিডির লক্ষণসমূহ: [চিন্তা থেকে আচরণ]

ওসিডির মূল দুইটি উপাদান হলো -

- অবাঞ্ছিত চিন্তা (obsessions) এবং 

- বাধ্যতামূলক কাজ (compulsions)।
 

- অবসেসিভ চিন্তা: বারবার কোনো ভয়াবহ বা অস্বাভাবিক চিন্তা, যেমন জীবাণু সংক্রমণের অতিরিক্ত ভয়, অনিদ্রা বা দুর্ঘটনার আশঙ্কা, অনৈতিক বা অবাঞ্ছিত ধারণা।

- কম্পালসিভ আচরণ: সেই ভয় দূর করতে বা চিন্তাকে সামলাতে বারবার হাত ধোয়া, দরজার তালা চেক করা, জিনিসপত্র সাজানো বা নির্দিষ্ট নিয়মে গোনার কাজ।
 

ওসিডি-এর প্রভাবে জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত

এই চিন্তা ও কাজের পুনরাবৃত্তি রোগীর জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে - কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ কমে, পারিবারিক সম্পর্ক জটিল হয়, আর মাঝে মাঝে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাও তৈরি হয়। অনেক সময় রোগীরা নিজেই তাদের সমস্যার কথা স্বীকার করতে ভয় পান বা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাহায্য নেয়ার পথে বাধা পায়।
 

বাংলাদেশে ওসিডির বাস্তবতা ও সচেতনতার অভাব

বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কম, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে ওসিডির মতো রোগগুলো সম্পর্কে তথ্য ও সেবা তেমন পৌঁছায় না। অনেক ক্ষেত্রে এটি 'অদ্ভুত অভ্যাস' বা 'ভয়ের মন্ত্র' বলে হেলাফেলা করা হয়, যা রোগীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর।
 

চিকিৎসা পদ্ধতি ও উন্নত থেরাপি

আজকের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে ওসিডি নিরাময়ে কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) সবচেয়ে কার্যকর। এর মধ্যে Exposure and Response Prevention (ERP) পদ্ধতি সবচেয়ে ফলপ্রসূ, যেখানে রোগী ধাপে ধাপে ভয় ও চিন্তার মুখোমুখি হয় এবং বাধ্যতামূলক কাজগুলো থেকে বিরত থাকার প্রশিক্ষণ নেয়। এছাড়াও, সেরোটোনিন পুনঃশোষণ ইনহিবিটর (SSRIs) নামক ওষুধও রোগের উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে।
 

সহানুভূতি ও সামাজিক ভূমিকার প্রয়োজন

ওসিডি নিয়ে সমাজে সঠিক ধারণা ও তথ্য ছড়ানো প্রয়োজন, যাতে রোগীরা বিচ্ছিন্ন না হয়ে মানসিক সেবার সুযোগ পায়। পরিবার ও সমাজের সহানুভূতিশীল আচরণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে সমর্থন করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি।
 

ওসিডি শুধু মানসিক রোগ নয়, এটি হলো এক ধরনের মস্তিষ্কের জটিলতা, যা সঠিক জ্ঞান ও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। মনের এই অদৃশ্য যুদ্ধকে বুঝে নিতে পারা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া মানেই হলো স্বাস্থ্যকর সমাজের দিকে এক বড় পদক্ষেপ।

মনে রাখুন, ওসিডি কোনো দুর্বলতা নয়-এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক অবস্থা। সচেতনতা, গ্রহণযোগ্যতা ও সহানুভূতিই আসল চাবিকাঠি।


সম্পর্কিত নিউজ