অ্যালার্জি: যখন শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই হয়ে ওঠে শত্রু

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের বৈজ্ঞানিক সমাজে অ্যালার্জি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি শুধুমাত্র সাধারণ অস্বস্তি নয়, বরং জীবনের গুণগত মান ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
অ্যালার্জির পেছনের কারণ -
অ্যালার্জি মূলত শরীরের ইমিউন সিস্টেমের অতিসংবেদনশীলতা। স্বাভাবিক অবস্থায় ইমিউন সিস্টেম ক্ষতিকর জীবাণু, ভাইরাস বা টক্সিনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু অ্যালার্জিতে ইমিউন সিস্টেম নিরাপদ কোনো পদার্থকে (যেমন: পরাগকণা, খাদ্য উপাদান, ধুলা, পশুর লোম) হুমকি হিসেবে ভুল বুঝে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এতে করে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, চুলকানি ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়।
এই অতিসংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ার পেছনে হিস্টামিন নামক রাসায়নিকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যখন অ্যালার্জেনের উপস্থিতি ইমিউন সেলগুলো শনাক্ত করে, তখন তারা হিস্টামিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক নিঃসৃত করে যা শ্বাসনালী, ত্বক ও লোমকূপে প্রদাহ
এবং ফোলা সৃষ্টি করে।
অ্যালার্জির প্রধান ধরন ও লক্ষণ -
১। অ্যালার্জিক রাইনাইটিস (নাকের অ্যালার্জি): হাঁচি, নাক বন্ধ বা পানি পড়া, চোখ লাল হওয়া।
২। অ্যাজমা (শ্বাসনালী অ্যালার্জি): শ্বাসকষ্ট, কাশি, বুকে জ্বালা।
৩। ডার্মাটাইটিস ও একজিমা: ত্বকে চুলকানি, ফোলা ও র্যাশ।
৪। খাদ্যজনিত অ্যালার্জি: পাকস্থলীতে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, কখনো কখনো অ্যানাফাইল্যাক্সিস নামক জীবনঘাতী শক।
৫। ঔষধজনিত অ্যালার্জি: ত্বকে ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া।
কেন বাড়ছে অ্যালার্জির সংখ্যা?
বিশ্বব্যাপী অ্যালার্জির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে পরিবেশগত ও সামাজিক কারণ রয়েছে:
- জলবায়ু পরিবর্তন: বায়ুর গুণগত মানের অবনতি এবং ফুলের পরাগের মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়া।
- বৃদ্ধমান দূষণ: শহরাঞ্চলের বায়ুদূষণ ইমিউন সিস্টেমকে অতিসংবেদনশীল করে তোলে।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অতিরিক্ততা (Hygiene Hypothesis): অতিরিক্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বড় হওয়া শিশুদের ইমিউন সিস্টেম প্রাকৃতিক উদ্দীপনা থেকে বঞ্চিত হয়, ফলে অ্যালার্জির ঝুঁকি বাড়ে।
- জেনেটিক ফ্যাক্টর: পরিবারে কারো অ্যালার্জি থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের ঝুঁকি বেশি।
আধুনিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধ কৌশল -
অ্যালার্জি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা কঠিন, তবে আধুনিক চিকিৎসা ও সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক।
- অ্যালার্জেন এড়িয়ে চলা: আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট অ্যালার্জেন চিহ্নিত করে তা এড়িয়ে চলা সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
- ঔষধোপচার: অ্যান্টিহিস্টামিন, কর্টিকোস্টেরয়েড ইনহেলার, ডিকংজেস্টেন্ট ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।
- ইমিউনোথেরাপি: ধীরে ধীরে অ্যালার্জেনের ছোট মাত্রা দেহে দেওয়ার মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেমকে "পুনঃশিক্ষিত" করা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে সহনশীলতা তৈরি করে।
নতুন গবেষণা: জিন থেরাপি, বায়োটেকনোলজি এবং অ্যান্টিবডি থেরাপির মাধ্যমে আরও কার্যকর ও স্থায়ী চিকিৎসার পথ তৈরি হচ্ছে।
সচেতনতা ও জরুরি পদক্ষেপ
অ্যালার্জি যত তাড়াতাড়ি সনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ততই গুরুতর জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে খাদ্য ও ওষুধজনিত অ্যালার্জি ক্ষেত্রে তৎপর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে অ্যানাফাইল্যাক্সিসের জন্য এপিপেন (ইপিনেফ্রিন) সঙ্গে রাখা উচিত।
অ্যালার্জি একটি বহুমুখী স্বাস্থ্য সমস্যা, যার সঙ্গে লড়াই চলছে আধুনিক বিজ্ঞানের। সচেতনতা, সঠিক জীবনযাপন ও চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয়ে অ্যালার্জির নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব। দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বুঝে, তার অতিসংবেদনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করাই বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ ও লক্ষ্য।