গাছের বায়ু বিশুদ্ধকরণের ক্ষমতা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বায়ুদূষণ বিশ্বজুড়ে এক গভীর সংকট। শহরের প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন বিষে ভরা, আর বাতাসে ভেসে বেড়ায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘাতক কণা। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রকৃতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা হয়ে উঠছে-গাছ। কিন্তু গাছ কি শুধু অক্সিজেন সরবরাহ করে? নাকি এর ক্ষমতা আরও বিস্তৃত?
বিজ্ঞান বলছে-গাছ কেবল ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ায় বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেনই নয়, বরং এটি একাধিক স্তরে বাতাসকে বিশুদ্ধ করে তোলে। গাছের পাতা, কাণ্ড, এমনকি গঠনগত বৈশিষ্ট্যগুলোও বাতাসে মিশে থাকা ধূলিকণা, রাসায়নিক বিষ ও ক্ষতিকর গ্যাস পরিশোধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কীভাবে গাছ বিশুদ্ধ করে বাতাস?
১। গ্যাস শোষণ প্রক্রিয়া (Gas Absorption): পাতার সূক্ষ্ম ছিদ্র বা স্টোমাটা দিয়ে গাছ বাতাস থেকে সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডসহ নানা ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে। এই গ্যাসগুলো পরবর্তীতে গাছের ভেতরে রাসায়নিকভাবে ভেঙে যায় বা মাটির নিচে চলে যায়।
২। পার্টিকুলেট ফিল্টারিং (Filtering Particulate Matter): বাতাসে ভেসে থাকা 'PM2.5' ও 'PM10' ধরনের ক্ষতিকর ধূলিকণা-যেগুলো ফুসফুসে গিয়ে জটিল রোগের জন্ম দিতে পারে-সেগুলো গাছের পাতার ওপর জমে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় এক একটি গাছ হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক ফিল্টার।
৩। বাষ্পীভবন ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ: গাছ শুধু বিষাক্ত কণা আটকায় না, এটি পরিবেশে আর্দ্রতা (humidity) বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে ধূলিকণা সহজেই মাটিতে বসে যায় এবং বাতাস তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার থাকে।
৪। VOC শোষণ: ঘরের ভেতরের বাতাসে থাকা ফরমালডিহাইড, বেনজিন, টলুইনের মতো ভোক (Volatile Organic Compounds) নামক বিষাক্ত উপাদানও নির্দিষ্ট কিছু গাছ (যেমনঃ পিস লিলি, স্নেক প্ল্যান্ট) শোষণ করতে সক্ষম।
শহরাঞ্চলে গাছের কার্যকারিতা কতটা?
ধারাবাহিক গবেষণায় দেখা গেছে-ঘনবসতিপূর্ণ শহর এলাকায় একটি সবুজ অঞ্চল আশপাশের তুলনায় প্রায় ৩০% পর্যন্ত কম বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ট্রাফিক-ঘন এলাকায় বড় পাতা ও ঘন ছায়াযুক্ত গাছ যেমন-আশ্বত্থ, বট, কাঁঠাল, নিম ইত্যাদি অনেক বেশি কার্যকর। গাছের আকৃতি, পাতা ধরন, ও পরিপক্বতা অনুযায়ী বায়ু বিশুদ্ধকরণের হার ভিন্ন ভিন্ন হলেও, গড়ে একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে ২০–২৫ কেজি পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে।
শুধু বাইরে নয়, ঘরের ভেতরেও সবুজ রক্ষা-কবচ
যেসব মানুষ দিনের বেশিরভাগ সময় কাটান ঘরের ভেতরে বা অফিসে, তারা চাইলে ঘরের কোণে রাখতে পারেন কিছু 'Indoor Plants'। NASA-র পুরনো এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, কিছু গাছ খুব দক্ষভাবে ঘরের বাতাসে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক গুলো শোষণ করে ঘরের পরিবেশ উন্নত করতে পারে।
স্নেক প্ল্যান্ট, মানি প্ল্যান্ট, পিস লিলি, আর অ্যারিকা পামের মতো গাছগুলো অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে ও VOC কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এমনকি রাতে কিছু গাছ (যেমন স্নেক প্ল্যান্ট ও অ্যালোভেরা) অক্সিজেন নিঃসরণ করে, যা ঘুমের জন্য উপকারী।
গাছ লাগান, বাঁচান বাতাস
জীবন রক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর, নিঃসন্দেহে সবচেয়ে কম খরচের ও টেকসই অস্ত্র গাছ। অতি দ্রুত নগরায়নের মধ্যে প্রতিটি বিল্ডিং, রাস্তার ধারে, স্কুল-কলেজে এমনকি বাড়ির ছাদেও গাছ লাগানো প্রয়োজন। শুধু লাগালেই হবে না-সেগুলোর পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাতাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা নীরব ঘাতকদের প্রতিরোধে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, প্রকৃতি নিজের ভেতরেই রেখে দিয়েছে এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা-গাছ। গাছ কেবল ছায়া দেয় না, এটি নীরবে কাজ করে যায় আমাদের জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাস বিশুদ্ধ করার জন্য। তাই নিজেকে ও পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে আজই নিতে হবে সিদ্ধান্ত-আরো বেশি গাছ লাগাতে হবে, আর তাকে আগলে রাখতে হবে যত্নে।
গাছ নয়, যেন নিঃশ্বাসের সবুজ প্রতিচ্ছবি।