মুঘল আমলে বাংলাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির নবজাগরণ

মুঘল আমলে বাংলাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির নবজাগরণ
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মুঘল শাসনামল, যা ছয়শো বছরেরও বেশি সময় আগে শুরু হলেও, আজকের বাংলাদেশে তার প্রভাব স্পষ্ট ও গভীর। শুধু রাজনৈতিক শাসন নয়, বরং এই সময়কালে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, স্থাপত্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এই যুগ ছিল এক অনন্য পালকবিহীন সময়, যা অনেক দিক থেকেই আধুনিকতার ভিত্তি গড়ে দেয়।

মুঘল শাসনের সময়ে ফারসি ভাষা প্রশাসনিক, সাহিত্য ও শিক্ষাব্যবস্থায় বিস্তার লাভ করে। এর ফলে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ফারসির মেলবন্ধন ঘটে, যা পরবর্তীতে বাংলা ভাষার ভাবধারা ও সাহিত্যকর্মে গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলার কবিতা, গজল ও সৃজনশীল সাহিত্যে এই যুগে নতুন মাত্রা যোগ হয়। বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরগুলো এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিদ্যার কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

জ্ঞানচর্চায় মুঘলরা ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র ও দর্শনের পাঠদান শুরু হয়, যা বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার বিকাশে সহায়ক ছিল। ঔপনিবেশিক আমলের আগে এই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বাংলার জ্ঞানমঞ্চের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। মুঘল আমলের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণকারীদের বর্ণনায় পাওয়া যায় বাংলার শিক্ষিত ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের চিত্র।

স্থাপত্যে মুঘল আমল এক স্থায়ী ঐতিহ্য রেখে গেছে। ঢাকার লালবাগ কেল্লা, মোঘলবাড়ি, সিরাজউদ্দৌলার আমলের বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসা বাংলার মুঘল স্থাপত্যকলার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এসব স্থাপত্যশৈলীতে ইসলামী আর্টের সূক্ষ্ম নিদর্শন যেমন আছে, তেমনি রয়েছে স্থানীয় বাংলার আদিবাসী ও হিন্দু স্থাপত্যের ছোঁয়া। নিখুঁত নকশা, সিমেট্রি ও টেরাকোটা কারুকাজের মাধ্যমে মুঘল স্থাপত্য বাংলার ভূপ্রকৃতিতে এক আলাদা মাত্রা যোগ করে।

সংস্কৃতিতে মুঘল প্রভাব বাংলা সঙ্গীত, নৃত্য ও খাদ্যসংস্কৃতিতেও সুস্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যেও মুঘল যুগের সঙ্গীত ও সংস্কৃতির প্রভাব ফুটে ওঠে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে বিরিয়ানি, কষা কোরমা ও মিষ্টান্নে মুঘল রান্নার ছোঁয়া স্পষ্ট। এছাড়াও, মুঘল আমলের পোশাক-আশাক, গহনা ও মেকআপ ধারা বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মুঘল আমলের শিক্ষাবিদ, শিল্পী ও গবেষকরা বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেন। ধর্মীয় সহনশীলতা ও সংস্কৃতির সমন্বয় সৃষ্টি হয়, যা আজকের বহু সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের মূলে রয়েছে। এই যুগের শিল্পকলা ও সাহিত্যবাংলার জাতীয় পরিচয়ের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আজকের বাংলাদেশে মুঘল আমলের অবদান শুধু ঐতিহাসিক স্মৃতি নয়, বরং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই যুগের প্রভাবের ধারাবাহিকতা আজও জীবন্ত, যা আমাদের জাতীয় গৌরব এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।

মুঘল আমল একটি ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ভিত্তিপ্রস্তর—যা আজকের আধুনিক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের মূল্য ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক দিক আজও আমাদের জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস। বাংলাদেশের ঐতিহ্যের এক আলোকবর্তিকা হিসেবে মুঘল আমলের এই প্রভাব ভবিষ্যতেও অবিচ্ছিন্ন থাকবে।


সম্পর্কিত নিউজ