মিষ্টি লিচুর আড়ালে লুকানো বিপদ: শিশুর জীবন বাঁচাতে জানতে হবে এই বিজ্ঞানসম্মত সতর্কতা

মিষ্টি লিচুর আড়ালে লুকানো বিপদ: শিশুর জীবন বাঁচাতে জানতে হবে এই বিজ্ঞানসম্মত সতর্কতা
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

গ্রীষ্মকালের এক প্রিয় ফল লিচু-রসালো স্বাদ আর মনোমুগ্ধকর গন্ধে এটি দেশের প্রায় সকল শিশু ও বড়দের হৃদয় জয় করে। কিন্তু এই মিষ্টি ফলের আড়ালে আছে এক বিপজ্জনক স্বাস্থ্যঝুঁকি, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, লিচু খাওয়ার সময় সঠিক সতর্কতা অবলম্বন না করলে এটি শিশুদের জন্য মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে।

লিচুর বিষাক্ত উপাদান: হাইপোগ্লাইসিন এ ও MCPG

প্রাকৃতিক লিচুতে থাকে দুটি জৈব রাসায়নিক যৌগ-'হাইপোগ্লাইসিন এ' এবং 'মেথিলিনসাইক্লোপ্রোপাইল-গ্লাইসিন' (MCPG)। এই যৌগ দুটি শরীরের গ্লুকোজ উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, বিশেষত যখন শিশুর পেট খালি থাকে। গ্লুকোজ হলো মস্তিষ্ক ও শরীরের প্রধান শক্তির উৎস। এই যৌগের প্রভাব থেকে শরীর পর্যাপ্ত গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে না, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত কমে যায়, যা 'হাইপোগ্লাইসেমিয়া' নামে পরিচিত।
 

শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি কেন বেশি?

শিশুদের লিভারে গ্লুকোজের সঞ্চিত পরিমাণ সীমিত। এ কারণে তারা দ্রুত হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় পতিত হতে পারে। বিশেষ করে পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিপদ বহুগুণ বেড়ে যায়। অপুষ্ট বা দরিদ্র শিশুরা এই সমস্যায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তাদের শরীরে ইতিমধ্যেই পুষ্টিহীনতার প্রভাব থেকে গ্লুকোজ উৎপাদন কম থাকে।
 

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ ও বিপদ

লিচু খাওয়ার পরে শিশুদের মধ্যে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে -

হঠাৎ বমি হওয়া, ঘুম হারানো, অতিরিক্ত ঘাম, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, ঘুমন্ত অবস্থায় খিঁচুনি বা অচেতন হওয়া।

তাড়াতাড়ি চিকিৎসা না নিলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি ঘটতে পারে, যা স্থায়ী অক্ষমতা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

 

পরিস্থিতির বাস্তব উদাহরণ

বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালে প্রায়ই সংবাদে দেখা যায়, শিশুরা রাতে খালি পেটে ঘুমিয়ে থেকে সকালে লিচু খাওয়ার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি 'লিচু সংক্রমণ' নয়, বরং 'লিচু-সম্পর্কিত হাইপোগ্লাইসেমিয়া'।

বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, লিচু থেকে উৎপন্ন রাসায়নিক শরীরের গ্লুকোজ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

 

কীভাবে নিরাপদে লিচু খাওয়াবেন?

⇨ কখনই শিশুকে খালি পেটে লিচু খেতে দেবেন না।

⇨ খাবারের পর বা সুষম নাস্তার পরে লিচু খাওয়ানো নিরাপদ।

⇨ সন্ধ্যা বা রাতের সময় লিচু খাওয়ানো এড়াতে হবে।

⇨ লিচুর পরিমাণ সীমিত রাখুন, বিশেষ করে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে।

⇨ শিশুর শরীরে অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

 

লিচু খাওয়ার সঠিক উপকারিতা

সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক সময়ে লিচু খেলে এটি শরীরে ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, এবং ফাইবার সরবরাহ করে।

এসব উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং পরিপাক  প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
 

সচেতনতা তৈরি করা সময়ের দাবি

আবহাওয়ার এই গরম মৌসুমে লিচু খাওয়ার প্রবণতা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে এই রোগের ঝুঁকিও। তাই অভিভাবক এবং সমাজকে এই বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে। সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর উচিত শিশুদের জন্য এই সতর্কতা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
 

লিচুর মিষ্টতা যেমন আনন্দ দেয়, ঠিক তেমনি এর বিপজ্জনক বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোও জানা জরুরি। শিশুদের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য আমাদের উচিত এই মৌসুমে লিচু খাওয়ার সময় 'বিজ্ঞান এবং সচেতনতা'র হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া। শুধুমাত্র তবেই রক্ষা পাওয়া যাবে শিশুর প্রাণ ও ভবিষ্যৎ।


সম্পর্কিত নিউজ