সুন্দরবন: জলবায়ুর ঢাল, জীবনের ভরসা

সুন্দরবন: জলবায়ুর ঢাল, জীবনের ভরসা
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত যে সবুজ রাজ্যটি নীরবে রক্ষা করে চলেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্য-তা হলো সুন্দরবন। এটি শুধু একটি বনভূমি নয়; বরং দক্ষিণাঞ্চলের জন্য এক অবিচ্ছেদ্য প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা বলয়। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট যখন বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, তখন সুন্দরবনের কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

এক নজরে সুন্দরবনের বৈশিষ্ট্য

সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, যার প্রায় ৬০% অংশ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থিত। এ বন প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, যা খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা জেলার উপকূল ঘিরে রেখেছে। ম্যানগ্রোভ বন অর্থাৎ লবণাক্ত পানিতে বেড়ে ওঠা বিশেষ ধরনের গাছ যেমন গেওয়া, সুন্দরী, গরান, পশুর-এই গাছগুলো গভীর শিকড় ছড়িয়ে উপকূলের মাটি আটকে রাখে, ঢেউয়ের ধাক্কা শোষণ করে ও ভূমিক্ষয় রোধ করে।
 

ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধে প্রাকৃতিক ঢাল

প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলকে আঘাত হানে, তাদের অভিঘাতকে প্রশমিত করতে সুন্দরবনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), মহাসেন (২০১৩), বুলবুল (২০১৯) কিংবা আম্পান (২০২০)-প্রতিটি দুর্যোগেই সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। গবেষণা বলছে, এই বন না থাকলে ঘূর্ণিঝড়ের গতি এবং জলচ্ছ্বাসের তীব্রতা আরও বহুগুণ বেশি ক্ষতি করতে পারত।
 

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব

সুন্দরবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক দিক হলো কার্বন শোষণ। ম্যানগ্রোভ গাছগুলো বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু উষ্ণতা হ্রাসে ভূমিকা রাখে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টর ম্যানগ্রোভ বন বছরে গড়ে প্রায় ১০ টন কার্বন শোষণ করতে সক্ষম, যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং রোধে কার্যকর। এছাড়া বনের আর্দ্রতা সংরক্ষণ, ক্ষুদ্র জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ভারসাম্য বজায় রাখতে সুন্দরবনের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
 

জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য

সুন্দরবন শুধু গাছপালার জন্য নয়, এটি প্রায় ৪৫০টিরও বেশি বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, লবণপানি কুমির, গাঙ্গেয় ডলফিন ও ৩৫০+ পাখি প্রজাতি উল্লেখযোগ্য। সুন্দরবনের এই জীববৈচিত্র্য পুরো উপকূলীয় পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখে, যা দক্ষিণাঞ্চলের বনভূমির সুস্থতা ও পরিবেশগত স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক।
 

অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র

উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সুন্দরবন একটি জীবিকা-নির্ভর সম্পদভাণ্ডার। মাছ, কাঁকড়া, মধু, গোলপাতা-এসব সংগ্রহ করেই হাজারো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বন সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে টেকসই করে তুলতে পারে।
 

হুমকি ও করণীয়

সুন্দরবনের অস্তিত্ব এখন নানা কারণে হুমকির মুখে। অবৈধ কাঠ সংগ্রহ, দাহ্য পদার্থে আগুন লাগা, নদীভাঙন, শিল্প দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বনের ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। জলস্তরের উচ্চতা বাড়া ও লবণাক্ততার বিস্তার বনের গাছ ও প্রাণীকুলের জন্য মারাত্মক। বিজ্ঞানভিত্তিক বন ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিকল্প জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর পরিবেশনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুন্দরবনকে রক্ষা করাই এখন সময়ের দাবি।

সুন্দরবন শুধু একটি বন নয়, এটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশগত ও মানবিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একটি প্রাকৃতিক দুর্গ। একে রক্ষা করা মানে বাংলাদেশের উপকূল রক্ষা করা, বনভূমি টিকিয়ে রাখা, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই জীবনধারা গড়ে তোলা। সময় এসেছে-সুন্দরবনকে 'সবুজ সীমানা' নয়, 'জীবনরক্ষাকারী সম্পদ' হিসেবে দেখার।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ