ডিপফেক প্রযুক্তির উত্থান, ঝুঁকি ও বিশ্ব বাস্তবতায় এর প্রভাব

ডিপফেক প্রযুক্তির উত্থান, ঝুঁকি ও বিশ্ব বাস্তবতায় এর প্রভাব
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বর্তমান ডিজিটাল যুগে তথ্যের দ্রুত প্রবাহ এবং ভার্চুয়াল মাধ্যমের বিকাশে এসেছে এক বিপ্লবাত্মক প্রযুক্তি, যার নাম ডিপফেক। "ডিপ লার্নিং" ও "ফেক" শব্দ থেকে উদ্ভূত এই প্রযুক্তি একদিকে যেমন বিনোদন জগতের চরিত্র বদলে দিয়েছে, অন্যদিকে তার অপব্যবহার সমাজ ও রাজনীতি প্রভাবিত করছে—বিশ্ববাসীর জন্য তৈরি হয়েছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ।

ডিপফেক কি এবং এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি

ডিপফেক হলো এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) প্রযুক্তি যা জেনারেটিভ অ্যাডভার্সেরিয়াল নেটওয়ার্ক (GAN) এর মাধ্যমে কাজ করে। GAN হলো দুটি নিউরাল নেটওয়ার্কের দ্বৈত সিস্টেম - একটি তৈরি করে নতুন ছবি বা ভিডিও, অন্যটি যাচাই করে সেই তৈরিকৃত কনটেন্ট বাস্তবের কাছাকাছি কিনা। এই প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় মেশিন শেখে কীভাবে মানুষের মুখ, কণ্ঠস্বর ও অভিব্যক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে অনুকরণ করতে হয়।

প্রকৃতপক্ষে, ডিপফেকের লক্ষ্য হচ্ছে একটি ব্যক্তির ভিডিও বা অডিওতে তার অবয়ব, কণ্ঠস্বর ও অনুভূতি এমনভাবে প্রতিস্থাপন করা যাতে তা প্রামাণিক মনে হয়। ২০১৭ সালের পর এই প্রযুক্তি দ্রুত বিকশিত হয়েছে, এখনকার দিনে যেকোনো ব্যক্তির ভিডিও তৈরি বা পরিবর্তন করা সম্ভব, এমনকি তার কণ্ঠস্বর নকল করাও।
 

ব্যবহার ও প্রভাব: সুবিধা ও ঝুঁকি

ডিপফেকের সুবিধা ব্যাপক। চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, এবং অনলাইন শিক্ষা খাতে এটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। অভিনেতা বা রাজনীতিবিদের পুরনো ভিডিও আপডেট করা, মৃত ব্যক্তির মুখ থেকে নতুন বক্তব্য তৈরি করা, এমনকি ভার্চুয়াল শিক্ষার জন্য শিক্ষকের কনটেন্ট তৈরি করাও এখন সম্ভব।

তবে বিপদও কম নয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি ভুয়া ভিডিও ও অডিও এখন অনেক সময় সত্যের সমান বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা, সামাজিক দ্বন্দ্ব, আর্থিক প্রতারণা, এবং ব্যক্তিগত চরিত্র হত্যার ক্ষেত্রে ডিপফেক ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনকালে ও করোনাকালে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে ডিপফেক ভিডিওর অবদান নজরকাড়া।
 

বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের প্রয়াস

বিশ্বের অনেক দেশ এখন ডিপফেক নিয়ে আইন প্রণয়ন করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আপডেট করে ডিপফেক নির্মাণ ও প্রচার নিয়ন্ত্রণে আনা শুরু করেছে। পাশাপাশি ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো এ ধরনের কনটেন্ট শনাক্ত করতে এআই-ভিত্তিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করছে।

কিন্তু প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা এবং ব্যবহারকারীদের সতর্কতা সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে উৎস নির্ভরতা বাড়ানো, সন্দেহজনক ভিডিও ও তথ্য শেয়ার না করা, এবং বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ মাধ্যম অনুসরণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
 

ভবিষ্যত: এক দৃষ্টিভঙ্গি

ডিপফেক প্রযুক্তির উন্নয়ন থামানো সম্ভব নয়, কারণ এটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি অংশ। তবে এর অপব্যবহার রোধ করতে হলে নৈতিক মানদণ্ড, আইনগত নিয়ন্ত্রণ, এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতা একসাথে কাজ করতে হবে। প্রযুক্তিকে সঠিক পথে ব্যবহার করলেই আমরা পেতে পারি উন্নত বিনোদন, শিক্ষা ও যোগাযোগের সুযোগ; অন্যথায় এটি হয়ে উঠবে ডিজিটাল যুগের সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তির হাতিয়ার।

যখন প্রযুক্তি সত্যের আবরণে মিথ্যার মুখোশ পরায়, তখন তথ্যের বিশুদ্ধতা ও সততার জন্য সংগ্রাম করাই হয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ডিপফেক প্রযুক্তি এভাবে ভবিষ্যতের ডিজিটাল সমাজের এক গভীর সংকট এবং সুযোগ উভয়ই বয়ে আনছে। আমাদের দায়িত্ব হবে এ প্রযুক্তিকে বুঝে, সচেতনভাবে ব্যবহার করে সত্যকে রক্ষা করা।
 

তথ্য সূত্র: প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থা ও সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী ডিপফেক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা


সম্পর্কিত নিউজ