জলবায়ুর আঘাতে উপকূলের স্কুল: শিক্ষা হারাচ্ছে, স্বপ্ন ঝরে যাচ্ছে

জলবায়ুর আঘাতে উপকূলের স্কুল: শিক্ষা হারাচ্ছে, স্বপ্ন ঝরে যাচ্ছে
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে এক নাজুক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, যার পেছনে মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব। শুধু ঘরবাড়ি বা কৃষি ক্ষেত্র নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত। নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ত পানির ক্রমবর্ধমান প্রবাহ উপকূলীয় বিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

পানির তলায় ক্লাসরুম খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর অনেক স্কুল বছরের কয়েক মাস বিভিন্ন মাত্রার বন্যায় প্লাবিত হয়। জলস্তর এমন পর্যায়ে ওঠে যে ক্লাসরুম পানিতে তলিয়ে যায়, বইপত্র নষ্ট হয়, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জরুরি সেবা ব্যাহত হয়। অনেক বিদ্যালয়ের পুরোনো নির্মাণশৈলী লবণাক্ত পানি ও জলাবদ্ধতার কারণে দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও পড়াশোনায় বিরূপ প্রভাব বিশ্বব্যাংক ও দেশের পরিবেশ গবেষণা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন জরিপ বলছে, উপকূলীয় বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি শতকরা হিসেবে ২০-৩০ ভাগ কমেছে। বন্যার কারণে রাস্তা বন্ধ থাকায় ও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে শিশুরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, আর অনেকে বাধ্য হয়ে স্কুল ছাড়ছে। এতে শিক্ষার মান ও ফলাফলও কমে যাচ্ছে।

লবণাক্ত পানির স্বাস্থ্যঝুঁকি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে শিশুরা পানির সঠিক পরিমাণ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। লবণাক্ত পানি শিশুদের কিডনি ও হজমতন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে, ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মনোযোগের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, যা শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

স্কুল অবকাঠামোর অবনতি পুরোনো ও কাদামাটি দিয়ে নির্মিত বিদ্যালয়গুলো দ্রুত ভেঙে পড়ছে, নতুন ভবন নির্মাণেও অর্থ ও উপকরণের অভাব দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি, স্কুলের আশেপাশে জলাবদ্ধতা ও স্যানিটেশন সংকট শিশুরা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে বাধাগ্রস্ত করছে।

পরিবেশ শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় 'জলবায়ু শিক্ষা' পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে উপকূলীয় এলাকার স্কুলগুলোতে এটি কার্যকর করতে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু শিক্ষার মান বাড়ানো নয়, পরিবেশ অভিযোজনের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর ও টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি।

ফ্লোটিং স্কুল ও ডিজিটাল শিক্ষার সম্ভাবনা উপকূলীয় এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে ফ্লোটিং স্কুল বা জলতরঙ্গ সহায়ক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষাও বিকল্প মাধ্যম হতে পারে, তবে সেগুলো কার্যকর করতে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও যথাযথ অর্থায়ন।

গ্লোবাল পদক্ষেপের প্রয়োজন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সীমিত করতে না পারলে, বাংলাদেশের উপকূলীয় শিক্ষা ব্যবস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আন্তর্জাতিক সমন্বয়, কার্বন নির্গমন হ্রাস ও স্থানীয় অভিযোজন কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।

উপকূলীয় এলাকার শিশুরা শুধু পড়াশোনা করছে না, তাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতও বিপন্ন। জলবায়ুর আগ্রাসনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের ও সমাজের সজাগ দৃষ্টি ও দ্রুত পদক্ষেপের বিকল্প নেই। টেকসই ও পরিবেশ-বান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি।


সম্পর্কিত নিউজ