উচ্চশিক্ষার মর্যাদা বনাম বাস্তবতার চরম বৈপরীত্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিদিনই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ডিগ্রি থাকলেও অধিকাংশ তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই শিক্ষিত বেকারত্ব দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে তারা হাতে সময় ও টাকা দিয়ে অর্জন করেছে উচ্চশিক্ষা, অন্যদিকে কর্মজীবনে প্রবেশের দরজা তাদের জন্য প্রায় বন্ধ। এর পেছনে আছে জটিল সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ ও শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা।
শিক্ষিত বেকারত্বের মাত্রা কতটা?
সরকারি ও বেসরকারি তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার দেশের মোট বেকারত্বের বড় অংশ। বিশেষ করে শহুরে অঞ্চলে এই সংখ্যা ক্রমেই বেড়েই চলছে। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের উচ্চশিক্ষিত বেকারদের প্রায় ৩০-৪০% দীর্ঘকাল চাকরিহীন।
মূল কারণগুলো বিস্তারিত:
১. শিক্ষাবিষয় ও চাকরির বাজারের সঙ্গতির অভাব: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা এমন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন যা বাজারে খুব একটা চাহিদাসম্পন্ন নয়। উদাহরণস্বরূপ, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে ডিগ্রি থাকলেও সংশ্লিষ্ট পেশায় নিয়োগের সুযোগ সীমিত। অন্যদিকে, তথ্যপ্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও ব্যবসায়িক বিষয়ের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও এই ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।
২. প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতার অভাব: বিশ্ব দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে, আর কর্মসংস্থানেও প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতার প্রয়োজন বাড়ছে। কিন্তু দেশে এখনও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাতে-কলমে বা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানোর সুযোগ কম। ফলে শিক্ষার্থীরা কাজের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুত হচ্ছে না।
৩. চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক ও তথ্যের অভাব: বিশেষ করে গ্রামীণ ও উপকণ্ঠের শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা প্রায়ই সময়মতো চাকরির তথ্য বা যোগাযোগের অভাবে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সীমিত ব্যবহার ও জ্ঞানের অভাব এটি বাড়িয়ে তোলে।
৪. সরকারি ও বেসরকারি খাতের সীমাবদ্ধতা: সরকারি চাকরির সংখ্যা সীমিত হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী সেখানে প্রতিযোগিতা করে পরাস্ত হচ্ছে। বেসরকারি খাতে যদিও সুযোগ আছে, তবে সেখানেও অনেক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও বিশেষ দক্ষতার অভাব থাকায় চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছে।
৫. উদ্যোক্তা মনোভাবের অভাব: কোনো দেশই শুধু সরকারি বা বেসরকারি চাকরির ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না। কিন্তু আমাদের তরুণ সমাজে আত্মনির্ভরশীল উদ্যোগ বা স্টার্টআপ তৈরির প্রবণতা সীমিত। ফলে স্বনির্ভরতার বিকল্প পথগুলো বিকশিত হচ্ছে না।
শিক্ষিত বেকারত্বের সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
বেকারত্ব শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মমর্যাদার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। হতাশা, উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাস হারানো, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। পরিবার ও সমাজের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যা সামগ্রিক সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
দেশীয় অর্থনীতি ও উন্নয়নের ওপর প্রভাব
শিক্ষিত বেকারত্ব অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দক্ষ জনশক্তির সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় উৎপাদনশীলতা কমে যায়। বিদেশ থেকে কর্মসংস্থান খোঁজার চাপ বাড়ে, এবং এই "বুদ্ধিজীবী গলার কাটা" সমস্যা দেশের সার্বিক উন্নয়নকে পিছিয়ে দেয়।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ
⇨ শিক্ষা নীতিতে বাজারভিত্তিক সংস্কার: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিলেবাস ও কোর্স কাঠামো বাজারের চাহিদা ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা।
⇨ কারিগরি ও দক্ষতা প্রশিক্ষণের প্রসার: ডিজিটাল দক্ষতা, সফট স্কিল, ভাষাগত দক্ষতা, এবং উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি।
⇨ চাকরির তথ্য ও নেটওয়ার্কিং সুযোগ বৃদ্ধি: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও ক্যারিয়ার সেন্টারগুলো সক্রিয় করে চাকরির তথ্য পৌঁছে দেওয়া।
⇨ উদ্যোক্তা উদ্যোগের প্রতি উৎসাহ: সহজ ঋণ সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপের মাধ্যমে নতুন ব্যবসার বিকাশ।
⇨ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: নতুন শিল্প-কারখানা, প্রযুক্তি পার্ক এবং স্টার্টআপ হাব তৈরি করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি।
শিক্ষিত বেকারত্ব মোকাবেলায় শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের দায় দেওয়া যাবে না; এটি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যার জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থাগত সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য শুধু ডিগ্রি নয়, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও উদ্যোগের সুযোগ তৈরি করাটাই এখন সময়ের দাবি। তাহলেই বাংলাদেশ তার সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।