চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে টিকে থাকার চাবিকাঠি: প্রোগ্রামিং শেখা শুরু হোক স্কুল থেকেই

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে টিকে থাকার চাবিকাঠি: প্রোগ্রামিং শেখা শুরু হোক স্কুল থেকেই
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে মানবজীবন বদলে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য গতিতে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, যা 'ডিজিটাল বিপ্লব' নামেও পরিচিত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence), রোবোটিক্স, বিগ ডেটা, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT), এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এর মতো প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে বিশ্বকে নতুন রূপে গড়ে তুলছে। এই বিশাল পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে প্রোগ্রামিং - সফটওয়্যার তৈরির মেধা ও দক্ষতা। প্রশ্ন হলো, "স্কুল পর্যায়ে প্রোগ্রামিং শেখা কেন এত জরুরি?"

প্রোগ্রামিং: আধুনিক সাক্ষরতার এক নতুন ধাপ

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, আধুনিক পৃথিবীর সাক্ষরতা শুধু বই পড়া-লেখা বা মৌলিক গণিতেই সীমাবদ্ধ নেই। 'কোডিং' বা প্রোগ্রামিং এখন এক নতুন ভাষা, যা শেখা জরুরি যেন আমরা কেবল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী না থেকে প্রযুক্তির স্রষ্টা হতে পারি।

প্রোগ্রামিং শেখার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কেবল কোড লিখতে শেখে না, বরং তারা 'কম্পিউটেশনাল থিঙ্কিং' অর্জন করে। এর মানে হলো—কোনো জটিল সমস্যাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে বিশ্লেষণ করা, প্যাটার্ন চিনে নেয়া, লজিক তৈরি করা এবং কার্যকর সমাধান বের করা। এটি শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপার হওয়ার জন্য নয়, জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
 

বিশ্বব্যাপী প্রোগ্রামিং শিক্ষার প্রবণতা

যুক্তরাষ্ট্রের 'Code.org' এর তথ্য অনুযায়ী, ৭০% নতুন চাকরির জন্যই বেসিক প্রোগ্রামিং ও আইটি দক্ষতা আবশ্যক হবে আগামী দশকে। এছাড়া, ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো স্কুলে প্রাথমিক স্তর থেকেই প্রোগ্রামিংকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাদের শিক্ষা নীতি থেকে স্পষ্ট যে, ছোট বাচ্চাদের মধ্যে ডিজিটাল দক্ষতা গড়ে তোলা হচ্ছে ভবিষ্যতের বাজারকে মাথায় রেখে।
 

বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিকতা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী দেশকে ডিজিটাল রূপান্তরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু, স্কুল পর্যায়ে প্রোগ্রামিং শেখার সুযোগ এখনো সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছায়নি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও প্রোগ্রামিংকে একটি অপশনাল বিষয় হিসেবে দেখা হয়।

তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ খাতে কর্মসংস্থানের চাহিদা বাড়লেও, দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এই অভাব পূরণ করতে হলে স্কুল পর্যায়ে প্রোগ্রামিং শেখানো বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেখানে শুধু কোড লেখা নয়, প্রকল্প ভিত্তিক শিক্ষা, রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রাথমিক ধারণা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
 

ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের জন্য প্রস্তুতি

বর্তমান বিশ্বে স্বয়ংক্রিয়তা ও মেশিন লার্নিংয়ের বিকাশের ফলে প্রচলিত অনেক কাজই অটোমেশন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। তবে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি, ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো ক্ষেত্রে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এই চাকরিগুলোতে প্রবেশের দরজা খুলতে প্রোগ্রামিং শেখা একেবারেই প্রয়োজনীয়।
 

প্রোগ্রামিং শেখার ভুল ধারণা ও বাস্তবতা

অনেকে মনে করেন, প্রোগ্রামিং শেখা কঠিন এবং শুধুমাত্র গাণিতিক মেধাবী ব্যক্তিদের জন্য। আসলে, প্রোগ্রামিং একটি ভাষার মতোই শেখা যায় ধাপে ধাপে। ছোটখাটো প্রকল্প থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বড় প্রোগ্রামে দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। শিক্ষাবিষয়ক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের আগ্রহ ধরে রাখতে গেম-ভিত্তিক কোডিং, সৃজনশীল সমস্যার সমাধান ও টিমওয়ার্কের ওপর জোর দিলে শেখার ফল ভালো হয়।
 

শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

সরকার ও শিক্ষাবিদদের উচিত শিক্ষাক্রমে প্রোগ্রামিংয়ের অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, যাতে তারা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বিত পাঠদান করতে পারে। পাশাপাশি, স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার ল্যাব, ইন্টারনেট সুবিধা, অনলাইন কোর্সের সুযোগ সম্প্রসারিত করতে হবে।
 

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে, প্রোগ্রামিং শেখা কেবল পেশাদারিত্বের বিষয় নয়; এটি হচ্ছে বেঁচে থাকার ও উন্নতির মাধ্যম। স্কুল পর্যায়ে প্রোগ্রামিং শেখানো হলে তা হবে দেশের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির জন্য মজবুত ভিত্তি। তাই, প্রযুক্তির ভবিষ্যত গড়ে তুলতে হলে আজই শুরু করতে হবে শিশুদের কোডিং শেখানো।

কেননা, আগামী দিনে সফলতা নির্ভর করবে শুধু ভাষা বা গণিতেই নয়-সফলতার নতুন ভাষা হবে 'কোড'।


সম্পর্কিত নিউজ