মহাকাশে সময় চলে ধীরে-কিন্তু কেন?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
সময় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে, সময় কি প্রকৃতপক্ষে সব জায়গায় একই রকম? আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো-সময় মহাকাশে এবং পৃথিবীতে একরকম চলে না। আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী, সময় আপেক্ষিক, অর্থাৎ পরিমাপকারীর গতি এবং মহাকর্ষের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে সময়ের গতি বদলাতে পারে।
আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ও সময়ের ধারা
বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (Special Relativity) আমাদের শেখায়, যখন কোনো বস্তুর গতি আলোর গতির খুব কাছে পৌঁছায়, তখন তার সময় পৃথিবীর সময়ের তুলনায় ধীরগতিতে এগোয়। এই 'টাইম ডিলেশন' (Time Dilation) নামক ঘটনা বাস্তবে বিভিন্ন পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চগতিতে চলাচলরত কণা বা ঘড়ির কাঁটা মহাকাশযানে পৃথিবীর ঘড়ির চেয়ে ধীরে চলে।
সাধারণ আপেক্ষিকতা (General Relativity) সময়ের ধীরগতির আরও এক কারণ ব্যাখ্যা করে: মহাকর্ষের প্রভাব। মহাকর্ষ যত শক্তিশালী, সময় তত ধীরগতিতে এগোয়। বিশাল মহাকর্ষ ক্ষেত্র যেমন ব্ল্যাক হোলের কাছে গিয়ে সময় 'টেনে' নেওয়ার মতো ধীরে চলে, যা 'মহাকর্ষীয় সময় প্রসারণ' নামে পরিচিত।
মহাকাশ অভিযানে সময়ের পার্থক্যের বাস্তব প্রমাণ
আমাদের চারপাশে সময়ের আপেক্ষিকতার প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় GPS স্যাটেলাইটে। পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে যাওয়া এই স্যাটেলাইটগুলোতে ঘড়ির সময় মহাকর্ষের প্রভাবে ও তাদের উচ্চগতির কারণে পৃথিবীর তুলনায় সামান্য আলাদা চলে। যদি এই পার্থক্য সংশোধন করা না হয়, তবে GPS-নির্ভর নেভিগেশন ব্যবস্থায় প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার ভুল হতে পারে।
আরেকটি নজরকাড়া উদাহরণ হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS)। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় কক্ষপথে থাকা এই স্টেশনের সময় পৃথিবীর তুলনায় সামান্য ধীরে চলে। যদিও এই পার্থক্য মিনিট বা ঘণ্টার স্তরে নয়, বরং সেকেন্ডের কিছু অংশের-এটি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সময়ের আপেক্ষিকতার গভীর প্রভাব
যদি ভবিষ্যতে মানুষ দূরের গ্রহ বা নক্ষত্রের দিকে ভ্রমণ করে, যেমন আলফা সেন্টাউরি, যেখানে যাত্রা অনেক বছর লেগে যেতে পারে, তখন মহাকাশচারীরা ফিরে আসলে পৃথিবীতে কেটে গেছে বহু দশক, অথচ তাদের জন্য সময় কেটে গিয়েছে সামান্য। এই ফেনোমেনাকে 'টাইম ট্রাভেল' বা সময় ভ্রমণ হিসেবে দেখা যায়, যদিও এটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনির গল্প নয়, বরং আইনস্টাইনের তত্ত্বের বাস্তব পরিণতি।
কেন সময় বদলায়?
সময় একটি মাত্রিক নয়, বরং স্থান ও গতি সহ একটি চার-মাত্রিক কাঠামো। মহাকাশ-কাল বা স্পেস-টাইম বলতে যা বোঝায়, তার মধ্যে সময় এবং স্থান একে অপরের সঙ্গে মিশে থাকে। যখন আমরা মহাকাশে উচ্চগতিতে যাই অথবা শক্তিশালী মহাকর্ষের কাছে যাই, তখন স্পেস-টাইম বাঁকানো হয়। এই বাঁকানো স্পেস-টাইম আমাদের সময়কে আলাদা গতিতে চলতে বাধ্য করে।
প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সীমানা পার
মহাকাশ প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সময়ের এই বৈজ্ঞানিক রহস্য আমাদের আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে ভবিষ্যতের মহাকাশযানে সময়ের আপেক্ষিকতার এই ধারণা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ হবে যাতে সঠিক তথ্য-সংগ্রহ এবং দীর্ঘকালীন মানব অভিযানের জন্য পরিকল্পনা করা যায়।
মহাকাশে সময়ের ধারা শুধু তাত্ত্বিক একটি বিষয় নয়, এটি বাস্তব জীবনের প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক প্রয়োগে প্রতিনিয়ত প্রমাণিত হচ্ছে। সময়ের আপেক্ষিকতা আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি ও সময়ের অর্থ নতুনভাবে বুঝতে সাহায্য করে। এই রহস্যময় গতি আমাদের দেখায়, সময় যেন একটি পরিবর্তনশীল প্রবাহ, যা মহাকাশের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্নরকম বয়ে চলে-বিজ্ঞান ও বাস্তবতার এক অবিস্মরণীয় সাক্ষ্য।