গাছ কীভাবে রাসায়নিক সংকেতে দূরের গাছকে সতর্ক করে!!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
প্রতিটি গাছ যেন প্রকৃতির নিঃশব্দ বার্তাবাহক। আমাদের চোখে তারা স্থির, কথা বলে না, কিন্তু গাছের মধ্যে একটি অত্যন্ত জটিল ও সক্রিয় যোগাযোগব্যবস্থা কাজ করে, যা বিজ্ঞানীরা "রাসায়নিক সংকেত প্রেরণ" হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই সংকেতগুলো গাছকে শুধু তাদের আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে জানায় না, বরং দূরের গাছগুলোকেও সতর্ক করে, বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত করে তোলে।
গাছের এই যোগাযোগের পেছনে থাকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। যখন কোনো গাছ পোকামাকড়ের আক্রমণে পড়ে, শিকড় বা পাতায় ক্ষত হয়, তখন সেই গাছ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সংকেত নির্গত করে। বিশেষ করে জ্যাসমোনিক অ্যাসিড (Jasmonic Acid), সালিসাইলিক অ্যাসিড (Salicylic Acid), এবং ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ডস (VOCs) এগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই রাসায়নিকগুলো বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বা মাটির মাধ্যমে আশপাশের গাছের কাছে পৌঁছায়।
এই সংকেত পেয়ে প্রতিবেশী গাছগুলো তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে। তারা আগেভাগেই শত্রু মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে, যা পোকামাকড়ের স্বাদ বদলে দেয়, বিষাক্ত হয়ে ওঠে অথবা তাদের বিকাশ থামিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এক গাছ যখন মিথাইল জ্যাসমোনেট (Methyl Jasmonate) নির্গত করে, তখন পাশের গাছগুলোও একই ধরনের রাসায়নিক প্রস্তুত করতে শুরু করে, যেন তারা একত্রে যুদ্ধে নামছে।
শুধু বাতাস নয়, মাটিতেও গাছের সংকেত পৌঁছায়। গাছের শিকড় থেকে মাটিতে নির্গত রাসায়নিক যৌগ আশপাশের গাছের শিকড়ের সঙ্গে মিশে যায়। এই প্রক্রিয়া ধীর গতিতে হলেও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। একে বিজ্ঞানীরা "রাইজোস্ফিয়ার সংকেত" বলে অভিহিত করেন। এই সংকেতের মাধ্যমে গাছগুলো মাটির ক্ষতিকর জীবাণু দূর করে, একে অপরকে পুষ্টি শেয়ার করার মতো কিছু কার্যকলাপও চালাতে পারে।
আধুনিক গবেষণা দেখিয়েছে, গাছের এই রাসায়নিক সংকেত পরিবেশের প্রতিকূলতা মোকাবেলায় অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এক প্রকার 'প্রাকৃতিক নেটওয়ার্ক' গঠন করে গাছগুলো একে অপরের সাথে জড়িত থাকে, যা কখনও কখনও "Wood Wide Web" নামে পরিচিত। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গাছেরা পরিবেশের তথ্য আদান-প্রদান করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।
গাছের এই রাসায়নিক সংকেতের রহস্য উন্মোচনে আধুনিক বিজ্ঞান যেমন মুগ্ধ, তেমনই এর প্রয়োগ ক্ষেত্রও ভবিষ্যতে কৃষি ও বনসম্পদের উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সংকেতগুলোর প্রকৃতি ও কার্যকারিতা বোঝার মাধ্যমে পোকামাকড় প্রতিরোধী নতুন ধরনের উদ্ভিদ উদ্ভাবন, বা পরিবেশবান্ধব
কীটনাশক তৈরির দিকেও পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।
সব মিলিয়ে, গাছের রাসায়নিক সংকেত আমাদের শেখায়—প্রকৃতি নিঃশব্দ হলেও তা যোগাযোগের একটি জটিল ও কার্যকরী ভাষা তৈরি করেছে। গাছেরা একে অপরকে সতর্ক করে, তাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধকে সহজ করে তোলে। তাই আগামী দিনে গাছের এই নীরব বার্তা বোঝা এবং ব্যবহারে আমরা নতুন এক যুগের সূচনা করতে পারব।