উদ্বেগ নয়, এটি রোগ: অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার নিয়ে যে সত্য আমরা এড়িয়ে যাই

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
অস্পষ্ট এক ভয়, বুক ধড়ফড় করা, ঘামাচ্ছে হাতের তালু, অথচ চোখে দেখা কোনো বিপদ নেই-এটাই অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। একবিংশ শতাব্দীর এই নীরব মহামারী এখন শুধু মানসিক দুর্বলতা নয়, বরং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত একটি জটিল মানসিক রোগ। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ এই অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, যাদের অনেকেই জানেন না, তাদের ভিতরে কী ভয়াবহ কিছু জন্ম নিচ্ছে।
উদ্বেগ নয়, এটি এক মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট-
অনেকেই মনে করেন অ্যাংজাইটি মানে 'সামান্য উদ্বেগ'। কিন্তু এটি তার চেয়েও অনেক বেশি। এটি এমন এক অবস্থা, যেখানে মস্তিষ্ক বারবার ভুল সংকেত পাঠাতে থাকে-যেমন মনে হতে পারে কিছু ভয়াবহ ঘটতে চলেছে, যদিও বাস্তবে কিছুই ঘটছে না।
একটি সাধারণ সামাজিক পরিস্থিতি যেমন জনসমক্ষে কথা বলা, পরীক্ষার আগে রাত জাগা, কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারভিউ-এসবই সাধারণ উদ্বেগ সৃষ্টি করে। কিন্তু যখন এই উদ্বেগ অকারণে, অতিরিক্ত মাত্রায় এবং বারবার অনুভূত হয়-তখন তা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে রূপ নেয়।
মস্তিষ্কের কোথায় জন্ম নেয় এই ভয়?
নিউরোসায়েন্স অনুযায়ী, মস্তিষ্কের Amygdala নামক অংশটি মূলত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এটি অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়, তখন কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন নামক স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয়, যা শরীরকে অপ্রয়োজনীয় সতর্কতা অবস্থায় নিয়ে যায়।
ফলাফল?
⇨ ঘনঘন নিঃশ্বাস
⇨ হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যাওয়া
⇨ মাথা ঝিমঝিম করা
⇨ শরীর ঝিম ধরে যাওয়া
⇨ এমনকি প্যানিক অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে
অ্যাংজাইটি কারা বেশি অনুভব করেন?
১। শিক্ষার্থীরা – পরীক্ষার চাপ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
২। কর্মজীবীরা – চাকরির অনিরাপত্তা, কাজের চাপ
৩। নারী – বিশেষ করে গৃহস্থালির দায়িত্ব, সন্তান লালন-পালন ও সামাজিক চাপ
৪। বয়স্ক মানুষ – নিঃসঙ্গতা, রোগ-ভোগ
৫। প্রযুক্তিনির্ভর তরুণ – সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত সময়, তুলনার সংস্কৃতি
অনেক সময় দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তা থেকে জন্ম নেয় জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার (GAD)।
কেউ কেউ আবার নির্দিষ্ট ভয় বা পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে 'ফোবিয়া' ধরনের অ্যাংজাইটি অনুভব করেন।
আবার প্যানিক ডিজঅর্ডারও হয়, যেখানে ব্যক্তি হঠাৎ ভয়ানক আতঙ্কে আক্রান্ত হন-একেবারে হঠাৎ, কোনো কারণ ছাড়াই।
চিকিৎসা -
সঠিক চিকিৎসায় অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসার মূল স্তম্ভ তিনটি:
☞ মনোচিকিৎসা – বিশেষ করে Cognitive Behavioral Therapy (CBT), যা চিন্তার ধারা ও প্রতিক্রিয়াকে ইতিবাচকভাবে গড়ে তোলে।
☞ ওষুধ – কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি বা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ দেওয়া হয়।
☞ জীবনধারার পরিবর্তন – যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং প্রযুক্তির সময় সীমিতকরণ।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় অ্যাংজাইটি, চুপচাপ যন্ত্রণার নাম
বাংলাদেশে এখনো মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় না। অধিকাংশ মানুষ এই সমস্যাকে 'ভিতর ভিতর চাপ' বা 'দুর্বল মানসিকতা' বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু দীর্ঘদিন অবহেলা করলে এই রোগ মানুষকে ডিপ্রেশনে ঠেলে দিতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে আত্মহননের মতো ভয়াবহ।
সচেতনতা বাড়াতে হবে, সহানুভূতি গড়ে তুলতে হবে
অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার চিকিৎসাযোগ্য। মানসিক অসুস্থতা কোনো লজ্জার বিষয় নয়। বরং যত দ্রুত বুঝে চিকিৎসা নেওয়া যায়, তত দ্রুত ফিরে আসা যায় স্বাভাবিক জীবনে।
যারা এই সমস্যায় ভুগছেন, তাদের পাশে থাকা জরুরি। 'তুমি বেশি ভাবো' বলা নয়, বরং বোঝার চেষ্টা করা জরুরি।
শরীরের অসুখ যেমন চিকিৎসা চায়, তেমনি মনের অসুখও যত্ন দাবি করে। অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার কোনো অলস ভয়ের নাম নয়-এটি বাস্তব, গভীর ও জরুরি মনোযোগ দাবি করে। সময়মতো সাহায্য নিলে জীবন আবারও হতে পারে আগের মতো প্রাণবন্ত, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।