মানুষের মগজ যখন নিজের বিরুদ্ধেই কাজ করে

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আপনি সকালে উঠে আয়নায় নিজেকে দেখলেন, কিন্তু মনে পড়ছে না—আপনি কে। পরিচিত মুখগুলো যেন অচেনা ভিড়ে মিশে গেছে। প্রতিদিন যেসব কাজ আপনার অভ্যাস ছিল, সেগুলোর পথনির্দেশ যেন হারিয়ে গেছে। অ্যালঝেইমার ঠিক এমনই-এটি কেবল স্মৃতিভ্রংশ নয়, এটি মানুষকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলে নিজের ভেতর থেকে।
অ্যালঝেইমার ডিজিজ (Alzheimer's Disease) একটি জটিল মস্তিষ্কজনিত রোগ, যা স্মৃতি, চিন্তাশক্তি এবং স্বাভাবিক আচরণ ধ্বংস করে দেয় দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায়। সাধারণ ভুলে যাওয়ার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো—এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও খারাপের দিকে যায় এবং এক সময় রোগী নিজের পরিচয়, আত্মীয়স্বজন এমনকি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজগুলো করাও ভুলে যেতে থাকেন।
মস্তিষ্কের ভিতরে যা ঘটে-
অ্যালঝেইমারে মস্তিষ্কের কোষের ভেতরে ও বাইরে অস্বাভাবিক প্রোটিন জমা হতে থাকে। গবেষকরা দেখেছেন, দুটি প্রধান প্রোটিন—বেটা-অ্যামিলয়েড (Beta-amyloid) ও টাউ (Tau)—এই রোগের মূল ভূমিকা পালন করে। বেটা-অ্যামিলয়েড প্ল্যাক তৈরি করে কোষের বাইরে জমা হয় এবং টাউ কোষের ভিতরে জট পাকিয়ে নিউরনের বার্তা আদান-প্রদান বিঘ্নিত করে।
ফলাফল? মস্তিষ্কের কোষগুলি আস্তে আস্তে মারা যেতে থাকে। প্রথমে স্মৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, চিন্তাভাবনা, ভাষা, এমনকি চলাফেরা পর্যন্ত প্রভাবিত হয়।
কতটা ভয়ানক এর বিস্তার!!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি ৫৫ জনে ১ জন অ্যালঝেইমারে আক্রান্ত। প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন নতুন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ডিমেনশিয়ায়, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শতাংশই অ্যালঝেইমার রোগী।
বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা নির্ভরযোগ্যভাবে পর্যবেক্ষণ না করা হলেও, বয়স্কদের মধ্যে এর উপস্থিতি বাড়ছে। শহরাঞ্চলে দেরিতে সন্তান হওয়া, মানসিক চাপ, একাকীত্ব, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো কারণে ঝুঁকি বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ।
কে ঝুঁকিতে বেশি?
☞ ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা
☞ যাদের পরিবারে অ্যালঝেইমারের ইতিহাস রয়েছে
☞ যাদের ঘনঘন মাথায় আঘাত লেগেছে
☞ যাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি হতাশা, নিঃসঙ্গতা বা ঘুমজনিত সমস্যা রয়েছে
☞ যারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাখেন না
প্রতিকার নেই, তবে প্রতিরোধ সম্ভব
এ রোগের জন্য এখনও নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই যা সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করতে পারে। তবে চিকিৎসা ও জীবনধারা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এর গতিরোধ বা বিলম্ব ঘটানো সম্ভব। যেমন:
⇨ নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম
⇨ মস্তিষ্কচর্চা (পাজল, বই পড়া, গণিত চর্চা)
⇨ স্বাস্থ্যকর খাবার (সবুজ শাকসবজি, বাদাম, ফলমূল)
⇨ মানসিক প্রশান্তি ও সামাজিক সংযোগ
⇨ উচ্চ রক্তচাপ ও সুগার নিয়ন্ত্রণ
কেন এই রোগ নিয়ে সচেতনতা জরুরি?
অ্যালঝেইমার শুধু একজন মানুষের সমস্যা নয়, এটি তার পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্ব। একজন রোগী ধীরে ধীরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার বুঝতেই পারে না—বয়সজনিত ভুল না, এটি একটি নির্দিষ্ট রোগ।
প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সচেতনতা বাড়ানো গেলে, শুরুতেই রোগ শনাক্ত করে যত্ন নেওয়া সম্ভব হয়।
অ্যালঝেইমার এমন এক রোগ, যা মানুষের পরিচয়, ইতিহাস, সম্পর্ক—সব কিছু নিঃশব্দে কেড়ে নেয়। কিন্তু সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনধারা এবং সহানুভূতিশীল পরিবেশ একে মোকাবেলা করার পথ দেখায়। স্মৃতি হারিয়ে গেলে মানুষ হারিয়ে যায় না—ভালোবাসা এবং সহানুভূতিই হতে পারে এই দীর্ঘ লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।