চাঁদাবাজি কবিরা গুণাহঃ কঠিন শাস্তির বিধান ইসলামে

চাঁদাবাজি কবিরা গুণাহঃ কঠিন শাস্তির বিধান ইসলামে
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

সমাজে এক ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে চাঁদাবাজি বা জোরপূর্বক অর্থ আদায়ের ঘটনা বর্তমানে প্রায়শই ঘটছে যা কেবল আইনগত অপরাধই নয়, বরং ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি একটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ (হারাম) এবং কবীরা গুণাহ বা বড় পাপের অন্তর্ভুক্ত। এই জঘন্য কর্মকাণ্ড সমাজের শান্তি, নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং পারস্পরিক বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে। চাঁদাবাজি একটি ঘৃণিত ও গর্হিত অপরাধ; এটি একপ্রকার দস্যুতা বা সন্ত্রাস। যারা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন পরকালীন শাস্তির হুঁশিয়ারি।

চাঁদাবাজি কী এবং এর ব্যাপকতাঃ
চাঁদাবাজি বলতে এমন কোনো কাজকে বোঝায় যেখানে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, শারীরিক ক্ষতির হুমকি দিয়ে, সম্মানহানির ভয় দেখিয়ে, বা অন্য কোনো অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে অর্থ, সম্পত্তি বা অন্য কোনো সুবিধা আদায় করে নেয়।এটি সাধারণত কোনো বৈধ অধিকার ছাড়াই অন্যের সম্পদ বা সুবিধা কেড়ে নেওয়ার একটি পদ্ধতি।
এর ব্যাপকতা এতটাই যে, এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণ খাত, পরিবহন এবং এমনকি দৈনন্দিন জনজীবনের ছোটখাটো লেনদেনেও পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায়, নির্মাণাধীন প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবি, কোনো সেবা প্রদানের বিনিময়ে অতিরিক্ত বা অবৈধ অর্থ দাবি, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় (ব্ল্যাকমেইল), এবং রাজনৈতিক বা পেশী শক্তির প্রভাবে অর্থ বা সুবিধা আদায়-এগুলো সবই চাঁদাবাজির বিভিন্ন রূপ।

ইসলামে চাঁদাবাজিঃ হারাম ও কবীরা গুণাহ
ইসলামে চাঁদাবাজিকে হারাম ঘোষণা করার মূল কারণগুলো অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট। এর গভীর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাব রয়েছে।  যেসব কারণে চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ ও গুণাহের-

•জুলুম ও অন্যের অধিকার হরণঃ ইসলাম শান্তির ধর্ম, এখানে অন্যায়ের কোনো স্থান নেই। চাঁদাবাজি হলো কারো কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করা, এটি সরাসরি জুলুম বা অন্যায়। অর্থাৎ সরাসরি জুলুম এবং অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে জুলুমকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। অন্যের সম্পদ তার অনুমতি ছাড়া বা জোরপূর্বক নেওয়া সুস্পষ্ট হারাম।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, "তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং বিচারকের কাছে এমন কোনো মামলা করো না, যার মাধ্যমে জেনে-বুঝে কারো সম্পদ আত্মসাৎ করো।" (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৮)।


রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, "কোনো মুসলমানের সম্পদ, তার আন্তরিক সম্মতি ছাড়া হস্তগত করলে তা হালাল হবে না।" (বায়হাকি, শু‘আবুল ঈমান, হাদীস: ১৬৭৫৬)।


•ভয়ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টিঃ চাঁদাবাজি সমাজে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে, যা মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করে। ইসলামে মানুষের জান-মাল (জীবন ও সম্পদ) এবং ইজ্জতের (সম্মান) নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি এই মৌলিক অধিকারগুলোকে সরাসরি লঙ্ঘন করে।


• ফিতনা-ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিঃ চাঁদাবাজি সমাজে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে। এটি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও শত্রুতা তৈরি করে, যা ইসলামী সমাজের মূলনীতির পরিপন্থী। চাঁদাবাজির মাধ্যমে সমাজের পারস্পরিক আস্থা ও নিরাপত্তা ধ্বংস হয়।


• হাদিসের নির্দেশনাঃ রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন হাদিসে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, "যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে, আল্লাহ তার উপর ক্রুদ্ধ হন।" (সহীহ বুখারী)।
আরেকটি হাদিসে এসেছে, "কোনো মুসলিমের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ছাড়া হালাল নয়।" (মুসনাদে আহমাদ)।

চাঁদাবাজি যেহেতু জোরপূর্বক সম্পদ আদায়, তাই এটি সুস্পষ্টভাবে হারাম এবং রাসূল (সা.) এর নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন।


•মুনাফিকী আচরণঃ চাঁদাবাজির মাধ্যমে যারা সমাজে প্রভাব বিস্তার করে, তারা প্রায়শই মুনাফিকের চরিত্র ধারণ করে, যারা মুখে ঈমানের দাবি করলেও কাজে এর বিপরীত। তাদের আচরণে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার অভাব স্পষ্ট হয়।


চাঁদাবাজির শাস্তিঃ দুনিয়া ও আখিরাত
চাঁদাবাজির জন্য ইসলামে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গাতেই কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যা এই অপরাধের ভয়াবহতা নির্দেশ করে।

দুনিয়ার শাস্তিঃ
চাঁদাবাজ সমাজে ঘৃণিত ও নিন্দিত হয়। মানুষ তাকে অবিশ্বাস করে এবং তার থেকে দূরে থাকে। তার কোনো সম্মান বা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না, যা একজন মানুষের সামাজিক জীবনের জন্য অনেক বড় শাস্তি।

চাঁদাবাজির জন্য শাস্তির বিধান- 

ইসলামী বিধানে আইনগত শাস্তিঃ চাঁদাবাজি একটি সন্ত্রাসমূলক অপরাধ। আল্লাহ তা’আলা তার জমিনে ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের জন্য চার ধরনের শাস্তির বিধান দিয়েছেন।
একজন চাঁদাবাজের জন্য এই চারটির যেকোনো শাস্তি প্রযোজ্যঃ ১) হত্যা করা হবে, ২) শূলে চড়ানো হবে (ফাঁসি), ৩) এক দিকের হাত ও বিপরীত দিকের পা কেটে ফেলা হবে, ৪) অন্য এলাকার জেলে বন্দি রাখা হবে তাওবা করার আগ পর্যন্ত।

আল্লাহ বলেন, "যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দেশে ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তি এই যে, তাদের হত্যা করা হবে, কিংবা শূলে চড়ানো হবে, অথবা তাদের এক দিকের হাত ও অন্য দিকের পা কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটা দুনিয়ায় তাদের জন্য লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।" (সূরা মায়িদাহ, আয়াত: ৩৩)।
এই শাস্তি নির্ভর করে চাঁদাবাজির ধরন, ক্ষতির পরিমাণ এবং সমাজে এর প্রভাবের উপর।

সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণঃ চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ অবৈধ এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে রাষ্ট্র তা বাজেয়াপ্ত করে জনকল্যাণে ব্যবহার করতে পারে।


আখিরাতের শাস্তিঃ

আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও অভিশাপঃ চাঁদাবাজি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা এবং তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ। এটি আল্লাহর অভিশাপ ডেকে আনে এবং পরকালে কঠিন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়।

জাহান্নামের কঠিন শাস্তিঃ কবীরা গুণাহ হিসেবে চাঁদাবাজির জন্য পরকালে জাহান্নামের কঠিন শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি শুধু দুনিয়ায় শাস্তির যোগ্য নয়, বরং আখিরাতে সে তার ভুক্তভোগীর পাপ নিজের ওপর বহন করবে, যদি ক্ষতিপূরণ না দেয়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, "যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে, সে যেন তাকে ক্ষমা করিয়ে নেয়- অন্যথায় কিয়ামতের দিন কোনো দিরহাম বা দিনার থাকবে না। তখন মজলুমের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।" (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৮৮৫)।
এটি অন্যের সম্পদ গ্রাস করার ভয়াবহতার একটি দৃষ্টান্ত, যা চাঁদাবাজির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।


হিসাব-নিকাশঃ কিয়ামতের দিন প্রতিটি অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেওয়া হবে। যারা চাঁদাবাজি করেছে, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকার আদায় করে দেওয়া হবে। যদি তাদের নেক আমল না থাকে, তবে ক্ষতিগ্রস্তদের পাপ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, যা এক ভয়াবহ পরিণতি।


চাঁদাবাজ ও তার সহযোগীদের দায়বদ্ধতাঃ
চাঁদা লেখক, উত্তোলনকারী, গ্রহণকারী ও উপভোগকারী- সবাই সমান অপরাধী। তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে সরাসরি জালিম অথবা জালিমের সহযোগী হিসেবে গণ্য হবে।
আল্লাহ বলেন, "শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। বস্তুত, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।" (সূরা শুরা, আয়াত: ৪২)।

সর্বপরি, চাঁদাবাজি শুধু আইনগত অপরাধ নয়- এটি একটি মারাত্মক ধর্মীয় গুনাহ। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। যারা এ কাজে জড়িত, তাদের উচিত খাঁটি তাওবা করে ক্ষতিগ্রস্তদের হক ফিরিয়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে এ অপরাধ থেকে দূরে থাকা।

এছাড়াও একজন প্রকৃত মুসলিমের জন্য অপরিহার্য হলো সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। চাঁদাবাজি থেকে বিরত থাকা এবং এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রতিটি মুসলিমের ঈমানী ও সামাজিক দায়িত্ব।
সমাজের প্রতিটি স্তরে এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য, যাতে একটি ইনসাফ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ