একুশ শতকের ক্লাসরুমে কি টিকে থাকবে প্রাচীন শিক্ষার মূল্যবোধ?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস এক ধ্রুপদী গাথা, যা বহু যুগ ধরে গড়ে উঠেছে চৈতন্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে। প্রাচীনকালে বাংলায় বিদ্যার মূল কেন্দ্র ছিল ধর্মীয় মঠ, আশ্রম এবং ছোট ছোট পাঠশালা। এই পাঠশালাগুলোতে শিষ্যরা হাতে কলমে লিখত তালপাতায়, আর মুখে মুখে শোনা পাঠে শিখত শাস্ত্র, সাহিত্য, গণিত ও দর্শন। শিক্ষা ছিল স্বনির্ভর ও পরম্পরাগত, যেখানে গুরু ও শিষ্যর সম্পর্ক ছিল গভীর এবং শিক্ষার চর্চা ছিল জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে নৈতিকতা ও মননশীলতার সমন্বয়।
পাল ও সেন শাসনামলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা আরও সমৃদ্ধ হয়। নালন্দা, বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব বাংলার শিক্ষার ওপর বিস্তৃত হয়েছিল। সংস্কৃত ও পালি ভাষায় ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষার অগ্রগতি ঘটে। এই সময় শিক্ষা ছিল একধরনের সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার প্রতীক। তবে এটি ছিল মূলত এক শ্রেণির মানুষের জন্য, জনসাধারণের মাঝে উচ্চ শিক্ষার প্রবাহ সীমিত ছিল।
মুঘল আমল এবং ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষায় নতুন দিক আসে। মক্তব, মাদ্রাসা, কলেজ ও পরে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয়, যা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দরজা খুলে দেয়। বাংলায় সাহিত্য চর্চাও জোরদার হয়, যা শিক্ষার বোধগম্যতাকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। তবে এই পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ ছিল এখনও সীমিত এবং অধিকাংশ মানুষ পড়াশোনা থেকে দূরে থাকত।
আজকের বাংলাদেশে শিক্ষার চিত্র একেবারেই পরিবর্তিত। ডিজিটাল যুগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জীবন-যাত্রা পাল্টে গেছে। স্মার্ট ক্লাসরুম, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন কোর্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে শিক্ষার পরিধি ও গুণগত মান উন্নত হচ্ছে। এখন আর শিক্ষার্থী শুধু বইয়ের পাতা উল্টায় না, তারা ইন্টারনেট ও বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো কোণের জ্ঞান হাতের নাগালে পায়।
তবে এই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক গভীর দৃষ্টিকোণ জরুরি—তাই 'মানবিক শিক্ষা' ও 'নৈতিক শিক্ষার' গুরুত্ব অপরিসীম। প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে যেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয় শুধু তথ্য অর্জন নয়, বরং চিন্তা করার ক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতের শিক্ষা হবে এই প্রাচীন জ্ঞানের ঐশ্বর্য আর আধুনিক প্রযুক্তির মিলিত রূপ, যা শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ ও বহুমাত্রিক বিকাশ নিশ্চিত করবে। বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার এই ধারাবাহিকতা ও উন্নয়নই হবে দেশের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
বাংলার শিক্ষা এখন অতীত ও ভবিষ্যতের এক জটিল মিলনস্থল, যেখানে তালপাতার লেখার নিপুণতা থেকে শুরু করে আধুনিক ডিজিটাল শিক্ষার বিস্ময়—সবই একসঙ্গে গড়ে তুলছে জ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত। এই অভিযাত্রাই বাংলাদেশের শিক্ষার প্রকৃত শক্তি ও সম্ভাবনার প্রতীক।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।