আমরা কি এক নিষ্ঠুর প্রজন্মের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষ সামাজিক প্রাণী, কিন্তু আজকের সমাজে একে অপরের অনুভূতি বোঝার যে ক্ষমতা—সহানুভূতি—তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা কাজের চাপের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা কি মানুষের 'মন' হারিয়ে ফেলছি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন—সহানুভূতির অবক্ষয় এখন শুধু মানবিক সংকট নয়, এটি একধরনের সামাজিক ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিক জরুরি অবস্থা।
সহানুভূতি কমছে কেন?
সহানুভূতি (Empathy) বলতে বোঝায়—অন্যের অনুভূতি অনুধাবন ও তার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানানোর মানসিক প্রবণতা। কিন্তু সাম্প্রতিক বৈশ্বিক গবেষণাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, গত দুই দশকে মানুষের সহানুভূতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিশেষত শহুরে সমাজে, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার অনিবার্য, সেখানে মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ফ্ল্যাটের দেয়ালে ঢুকে পড়েছে আলাদা আলাদা জীবন, আর মোবাইল স্ক্রিনে আটকে যাচ্ছে হৃদয়ের সংযোগ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজার ফলোয়ার থাকলেও—বাস্তব জীবনে একজন সহানুভূতিশীল শ্রোতার অভাব মানুষকে মানসিকভাবে আরও একাকী করে তুলছে।
নিউরোসায়েন্স বলছে, আমাদের মস্তিষ্কে থাকা 'মিরর নিউরন' নামক কোষগুলো অন্যের আবেগ অনুভব করতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন মানুষ ক্রমাগত ভার্চুয়াল কনটেন্টে অভ্যস্ত হয়, তখন এই নিউরনের প্রতিক্রিয়া কমে যায়। এর মানে দাঁড়ায়—আমরা আর অন্যের দুঃখে কষ্ট পাই না, বরং উদাসীন থাকি।
এই মানসিক পরিবর্তন ধীরে ধীরে রূপ নেয় সামাজিক আচরণে: দেখা যায়, কেউ দুর্ঘটনায় পড়লেও পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায় মানুষ—কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না, বরং কেউ কেউ ভিডিও ধারণ করে, সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট দেয়। এটি নিছক ট্রেন্ড নয়, এটি সহানুভূতির মূলোৎপাটনের প্রমাণ।
প্রজন্মও হারাচ্ছে মানবিক শিক্ষা!
বর্তমান প্রজন্ম বড় হচ্ছে স্মার্টফোন, গেম, এবং অনলাইন ক্লাসের জগতে। শৈশবে যে মানবিকতা শেখা দরকার, তা হারিয়ে যাচ্ছে একা বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতায়। পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা, গল্প করা, কাউকে সময় দেওয়া—এই ছোট ছোট মানবিক অভ্যাসগুলো আজ বিলুপ্তির পথে।
শিক্ষাব্যবস্থায় যান্ত্রিকতা ও পরীক্ষানির্ভর মানসিকতা শিশুদের হৃদয়ে নয়, বরং শুধু মস্তিষ্কে বিনিয়োগ করছে। এর ফলে তারা হয়তো মেধাবী হচ্ছে, কিন্তু মানবিক নয়।
সমাজে এর প্রভাব কী?
সহানুভূতির অভাবে সমাজে বেড়েছে মানসিক রোগ, সম্পর্কহীনতা, পারিবারিক বিচ্ছেদ, কর্মক্ষেত্রে টেনশন ও সামাজিক বৈরিতা। প্রতিদিন যে সহিংসতার খবর আমরা দেখি—তা কেবল অপরাধের নয়, সহানুভূতির অনুপস্থিতির ফলও।
এমনকি কর্মক্ষেত্রেও সহানুভূতিহীনতা সমস্যা তৈরি করছে—সহকর্মীর অসুস্থতায় সহানুভূতি নেই, ভুল হলে সহানুভূতির বদলে তিরস্কার, মানুষ মানুষকে আর মানুষ হিসেবে নয়—কর্মযন্ত্র হিসেবে দেখছে।
সমাধান কী?
মানবিকতা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন—
⇨ পরিবারে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো
⇨ শিক্ষা ব্যবস্থায় আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার প্রশিক্ষণ
⇨ সামাজিক প্রচারণায় সহানুভূতিশীল আচরণ উৎসাহিত করা
⇨ অনলাইন সময় কমিয়ে বাস্তব জীবনে যুক্ত হওয়া
কর্মক্ষেত্রে সহানুভূতির চর্চা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—সহানুভূতি চর্চা করলে মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা বাড়ে, যা সম্পর্ক, আস্থা ও শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলে।
সহানুভূতি শুধু একটি মানবিক গুণ নয়—এটি একটি সামাজিক ভিত্তি, যা ভেঙে পড়লে সম্পর্কের কাঠামো ভেঙে যায়, সমাজ নিষ্ঠুর হয়।
এই প্রশ্নটি এখন সবার সামনে—আমরা কি সত্যিই উন্নত হচ্ছি, নাকি হারিয়ে ফেলছি আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান পরিচয়—"মানবতা"?
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।