কলা মানেই প্রেম, কাঁঠালে আসে ধন—ফলের নামেই বাঙালির ভাগ্যগাথা!

কলা মানেই প্রেম, কাঁঠালে আসে ধন—ফলের নামেই বাঙালির ভাগ্যগাথা!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলা সংস্কৃতির মাধুর্য অনেকাংশেই ফুটে ওঠে তার দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট খুঁটিনাটি থেকে। বিশেষ করে ফলের নাম নিয়ে প্রচলিত প্রবাদ, কুসংস্কার ও সংস্কৃতি তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে চোখে পড়ে একটি গভীর ইতিহাস ও বৈজ্ঞানিক সত্যের মিলনস্থল। খাদ্য হিসাবে ফলের পুষ্টিগুণ তো বটেই, এদের নাম ও গুণাগুণ দিয়ে বাঙালি মনের অনুভূতিও প্রকাশ পায়, যা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

প্রবাদ থেকে শুরু করলে, 'কলা খেলে প্রেম জমে', 'আম খেলে মুখ মিষ্টি হয়', 'কাঁঠাল মানেই সুখ-সমৃদ্ধি'—এমন অনেক প্রবাদ আছে যা শুধু কথ্য প্রচলন নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন আচরণ ও বিশ্বাসের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এই প্রবাদগুলোর পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যা কুসংস্কারকে যুক্তির আলোকে দেখতে সাহায্য করে।

উদাহরণ হিসেবে কলা। কলায় প্রচুর পরিমাণে ট্রিপটোফ্যান থাকে, যা মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক 'সুখের হরমোন' তৈরি করতে সহায়তা করে। সেরোটোনিনের উপস্থিতি মানুষের মন ভালো রাখে, মানসিক চাপ কমায় এবং শান্তি দেয়। তাই, 'কলা খেলে প্রেম জমে'—এটি একটি সহজ সরল অথচ বৈজ্ঞানিকভাবে সাপোর্টেড ধারণা। এছাড়া কলায় রয়েছে পটাসিয়াম ও ভিটামিন বি৬, যা দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে সহায়ক।

 

কাঁঠাল নিয়ে বাংলার লোকবিশ্বাসে 'রাজফল' হিসেবে সম্মানিত। একসময় কৃষিপ্রধান সমাজে যারা কাঁঠাল ফলাতো, তারা খাদ্য নিরাপত্তায় বেশ এগিয়ে থাকতো। কাঁঠালে রয়েছে প্রচুর ফাইবার, ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে কাঁঠাল ধরাকে শুভ লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়েছে। এমনকি বাংলার লোকসংস্কৃতিতে কাঁঠালের পোকা অর্থাৎ 'কাঁঠাল পোকা'রও নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার দেখা যায়, যা ঐতিহ্যের অংশ।

 

আমের প্রসঙ্গেও অনেক প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে—'আম খেলে ঝগড়া মিটে' বা 'আমের গন্ধে মন ভালো হয়'। এই প্রবাদগুলোর পেছনে আমের সুগন্ধি, মিষ্টতা ও পুষ্টিগুণ যেমন আছে, তেমনি আম খাওয়ার সময় যে আনন্দ ও স্বস্তি পাওয়া যায় তা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সম্পর্কের সমঝোতায় সহায়ক। আমে থাকে ভিটামিন এ, সি এবং নানা ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ত্বক ও দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

কিছু ফল যেমন তেঁতুল বা লেবুর সঙ্গে নেতিবাচক কুসংস্কার জড়িয়ে আছে—'তেঁতুল মুখো' বা 'লেবু হাতে দিলে ভাগ্য বদলে'। যদিও তেঁতুলে প্রচুর অর্গানিক অ্যাসিড থাকে যা হজম ভালো করে এবং লেবুতে রয়েছে ভিটামিন সি, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এই দ্বৈততা সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের মধ্যে একটি মেলবন্ধন, যা আমাদের সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকেই নির্দেশ করে।

 

ফলের নাম শুধু দৈনন্দিন কথা নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক আচারেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালির পুজো-উৎসবে কলাপাতা, আমপাতা, পেয়ারা ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে। মুসলিম সমাজে রমজান-ঈদের সময়ে খেজুর ও খুমান ফলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, যা ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।

 

সুতরাং, ফলের নাম ঘিরে বাঙালির বিশ্বাস ও কুসংস্কারের পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সমন্বয়। এটি আমাদের শিক্ষা দেয়—কোনো সংস্কার বা বিশ্বাস বুঝে শুনে গ্রহণ করতে হবে, কারণ অনেক সময় তা খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বাস্তবতাকে সমর্থন করে। সেই সঙ্গে আমাদের উচিত কুসংস্কারের নেতিবাচক দিকগুলো চিন্তা-ভাবনা করে সমসাময়িকভাবে মূল্যায়ন করা।

 

বাঙালি সংস্কৃতির এ ফলভিত্তিক বিশ্বাস আর প্রবাদ আমাদের জীবনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এসে পৌঁছেছে। এটাই আমাদের ঐতিহ্য, এটাই আমাদের পরিচয়। আর এ পরিচয়কে আরও মজবুত করতে, এর পেছনের বিজ্ঞানের জ্ঞান জানতে আগ্রহী হলে আমরা সংস্কৃতির আসল অর্থ ও গুরুত্ব বুঝতে পারব।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ