বাঁচতে হলে শুধু হৃদস্পন্দন নয়, মনেরও চাই যত্ন

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
যতটা জরুরি শরীরের চিকিৎসা, ততটাই প্রয়োজন মনের যত্ন। কিন্তু বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেন আজও একটি উপেক্ষিত অধ্যায়। যেখানে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্য একদিকে উচ্চতর, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার কাঠামো আজও থমকে আছে এক প্রান্তিক বাস্তবতায়।
মানসিক রোগ—কেবল সমস্যা নয়, এটা এক 'নীরব মহামারী'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি আটজন মানুষের একজন ভুগছে মানসিক সমস্যায়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। একাধিক সরকারি জরিপে উঠে এসেছে—দেশের প্রায় ১৮% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। তবুও এ দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে এখনো চিকিৎসা খাতের "অপ্রিয়" বিভাগ হিসেবে দেখা হয়।
পরিসংখ্যান বলছে -
বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) আছেন প্রায় ২২০ জনের মতো—যেখানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি! অর্থাৎ প্রতি ৭ লাখ ৭০ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে একজন বিশেষজ্ঞ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে যেখানে প্রতি লাখে অন্তত এক জন বিশেষজ্ঞ থাকার কথা বলা হয়, সেখানে আমাদের ঘাটতি ভয়াবহ।
কেন এত পিছিয়ে আমরা?
◑ সামাজিক কুসংস্কার ও ভুল ধারণা: "মন খারাপ তো ঠিক হয়ে যাবে"—এই জাতীয় মন্তব্য আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বাস্তবতা বোঝার প্রধান বাধা। অনেক পরিবার এখনো মানসিক রোগকে 'পাগলামি' হিসেবে চিহ্নিত করে, চিকিৎসা নয় বরং লুকিয়ে রাখাকে বেছে নেয়।
◑ পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব: দেশের অধিকাংশ জেলা হাসপাতালে নেই পূর্ণাঙ্গ মানসিক স্বাস্থ্য ইউনিট। যেগুলো আছে, সেখানে নেই প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর, পর্যাপ্ত ওষুধ কিংবা ব্যক্তিগত থেরাপির ব্যবস্থা।
◑ অর্থ বরাদ্দের ঘাটতি: স্বাস্থ্য বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ থাকে প্রায় ১% এরও কম—যা বাস্তব পরিস্থিতির তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত।
তরুণদের মধ্যে বিপদ আরও বেশি
বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ (anxiety), বিষণ্নতা (depression), আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়াবহ হারে বাড়ছে। পরীক্ষার চাপ, ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তা, সম্পর্কজনিত মানসিক দ্বন্দ্ব ও সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক আত্মসমালোচনা তরুণ মস্তিষ্কে বিপজ্জনক প্রভাব ফেলছে।
সমাধানের দিকনির্দেশনা কোথায়?
◑ স্কুল-কলেজে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা: সচেতনতা শুরু হোক কৈশোর থেকেই।
◑ প্রতিটি উপজেলায় কমিউনিটি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র: প্রশিক্ষিত পরামর্শদাতার মাধ্যমে সুলভ ও গোপনীয় সেবা।
◑ অনলাইন হেল্পলাইন ও মোবাইল অ্যাপ: যেখানে মানুষ চুপচাপ মন খুলে বলতে পারে, পরিচয় গোপন রেখে।
◑ গণমাধ্যম ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা: মানসিক অসুস্থতাকে 'দোষ' নয় বরং 'সমস্যা' হিসেবে উপস্থাপন করাই জরুরি।
মানুষ শুধু শরীর নয়, মনেরও নাম। শারীরিক চিকিৎসার মতোই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা একটি মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে হাঁটছে, কিন্তু সেই অগ্রগতিকে টেকসই করতে হলে চাই এক মননশীল, মানসিকভাবে সুস্থ প্রজন্ম। এখন সময় এসেছে—চুপ না থেকে মনকেও শোনা, বোঝা এবং সেবা দেওয়ার।
নইলে একদিন শুধু দেহ থাকবে, কিন্তু মন থাকবে না। আর সেটাই হবে জাতিগত দুর্যোগ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।