অদৃশ্য টানেল, থেমে থাকা সময়ের এক রহস্যময় গহ্বরের সন্ধান

অদৃশ্য টানেল, থেমে থাকা সময়ের এক রহস্যময় গহ্বরের সন্ধান
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু 'ব্ল্যাক হোল' বা বাংলায় 'সিংহগহ্বর' আমাদের জানা জ্ঞানের সীমাকে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই গহ্বর এমন এক জায়গা, যেখানে মহাকর্ষ বল এতই প্রবল, যে আলো সহ কোনো কিছুরই পালানোর পথ থাকে না। বিজ্ঞানীদের কাছে এটি মহাকাশ ও সময়ের সবচেয়ে চমকপ্রদ রহস্য, যা এখনো পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি।

গঠন

ব্ল্যাক হোল মূলত একটি অত্যন্ত সংকুচিত বস্তু, যা সাধারণত একটি বিশাল নক্ষত্রের মৃত্যুর পর তৈরি হয়। যখন কোনো নক্ষত্রের জীবনীচক্র শেষ হয়, তখন তার কেন্দ্রীয় অংশ নিজের মধ্যেই সংকুচিত হয়ে পড়ে, প্রচণ্ড ঘনত্ব আর শক্তি নিয়ে। এর ফলে সেই স্থানে গড়ন হয় 'সিঙ্গুলারিটি', যেখানে পদার্থের ঘনত্ব অসীম এবং আমাদের পরিচিত পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো কাজ করে না।


ঘটনা হরাইজন — ফিরবার নেই পথ

ব্ল্যাক হোলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ইভেন্ট হরাইজন বা 'ঘটনা সীমা'। এটি হলো সেই কাল্পনিক সীমানা, যার একবার ভেতরে ঢুকে পড়লে কোনো কিছুই ফিরে আসতে পারে না। এটি মূলত ব্ল্যাক হোলের এমন একটি সীমা, যেখানে মহাকর্ষের আকর্ষণ এত প্রবল যে, আলোর কণাও বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। এই সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর সময়, স্থান এবং গতি সবকিছুই অন্যরকম আচরণ করতে শুরু করে।


সময়ের বক্ররেখা— মহাকর্ষ আর সময়

আইন্সটাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, ব্ল্যাক হোলের মতো তীব্র মহাকর্ষ ক্ষেত্র সময়কে গরম হলে যেমন ধীরে যায়, তেমনই এই অঞ্চলগুলোতে সময়ের গতি বাইরের তুলনায় অনেক ধীর হয়ে যায়। অর্থাৎ, ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি গেলে সময় বাইরের পৃথিবীর তুলনায় একদম ধীরগতিতে চলবে। এটি একধরনের বাস্তব 'সময় ভ্রমণ' বা টাইম ডাইলেশন, যা বিজ্ঞানের এক দারুণ উদ্ভাবনী ধারণা।


ব্ল্যাক হোলের প্রকারভেদ

ব্ল্যাক হোল বিভিন্ন ধরনের হয়:

১। স্টেলার ব্ল্যাক হোল: যেগুলো সাধারণত বড় নক্ষত্রের মৃত্যুর পর তৈরি হয়, ওজন হয় সূর্যের কয়েক গুণ থেকে কয়েক দশ গুণ পর্যন্ত।

 

২। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল: গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে থাকে, যেমন আমাদের মিল্কিওয়ের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত সাগিটারিয়াস এ*। এগুলোর ভর থাকে সূর্যের কোটি কোটি গুণ।

 

৩। মধ্যম আকারের ব্ল্যাক হোল: যা স্টেলার ও সুপারম্যাসিভের মধ্যবর্তী, এবং এর অস্তিত্ব এখনো সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয়নি।


যেহেতু ব্ল্যাক হোল নিজেই কোনো আলো বা বিকিরণ প্রকাশ করে না, তাই বিজ্ঞানীরা এদের উপস্থিতি নিরূপণ করেন পার্শ্ববর্তী গ্যাস ও ধূলোর বিকিরণ, নিকটবর্তী নক্ষত্রের অস্বাভাবিক গতিবিধি, অথবা সম্প্রতি আবিষ্কৃত গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ প্রথমবারের মতো একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ছবি ক্যাপচার করেছিলো, যা ছিল মহাকাশ বিজ্ঞানের এক বিরাট মাইলফলক।


ভবিষ্যত গবেষণা

ব্ল্যাক হোল নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও নানা ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি—সময়ের প্রকৃতি, মহাকাশের বিন্যাস, এমনকি তথ্যের অবনতি বা সংরক্ষণ নিয়ে। তারা এখনো খুঁজছেন, ব্ল্যাক হোল কি সময় ভ্রমণের দ্বার খুলতে পারে? অথবা মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন তথ্য দিতে পারে? গবেষণার এই ক্ষেত্র একদিকে যেমন কঠিন, অন্যদিকে তেমনি চমকপ্রদ।

 

 মহাকাশের সিংহগহ্বর শুধু পদার্থবিজ্ঞানের এক রহস্য নয়, এটি সময়, স্থান এবং বাস্তবতার মিশ্রণ, যা আমাদের মহাবিশ্বের গভীরতম সত্যের দিকে নিয়ে যায়। 

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ