খেলাপি ঋণের জালে ১০০ প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩ পদ্মা সেতুর সমান অর্থ আটক

খেলাপি ঋণের জালে ১০০ প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩ পদ্মা সেতুর সমান অর্থ আটক
  • Author, এএন জাহান
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

দেশের আর্থিক খাত বর্তমানে খেলাপি ঋণের ভয়াবহ ক্যানসারে আক্রান্ত। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ১৩২ কোটি টাকা, যা দেশের মোট খেলাপি ঋণের ২৬ শতাংশ বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শীর্ষ ১০০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬২টি প্রতিষ্ঠানই শতভাগ খেলাপি। অর্থাৎ, এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ ঋণই আদায় অযোগ্য। এই অর্থের একটি বড় অংশই সরকারি ব্যাংক থেকে নেওয়া। 
উল্লেখ্য, এই ১০০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪৫ শতাংশই এস আলম এবং বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।

চলুন দেখি এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপের দাপটঃ-

এস আলম গ্রুপঃ এই গ্রুপের ১০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট পাওনা ৬১ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মার্চ পর্যন্ত ২২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা খেলাপি দেখানো হয়েছে।
এই তালিকায় রয়েছে এস আলম ভেজিটেবল, এস আলম কোল্ড রোলেন্ড স্টিল, এস আলম রিফাইন সুগার, এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন, আইডিয়াল ফ্লাওয়ার মিলস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, সোনালী ট্রেডার্স এবং ইনফিনিট সিআর স্পিট্রিকস গার্মেন্ট। এর বাইরেও এস আলম গ্রুপের আরও খেলাপি ঋণ রয়েছে যা শীর্ষ ১০০-এর তালিকাভুক্ত হয়নি।

বেক্সিমকো গ্রুপঃ নামে-বেনামে এই গ্রুপের ২৮টি প্রতিষ্ঠানের নামে ২৮ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে, যার মধ্যে ২৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকাই খেলাপি। এই ২৮ প্রতিষ্ঠানের ২৬টিই শতভাগ খেলাপি।
বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট ওয়ান, বেক্সিমকো কমিউনিকেশন, ইয়োলো অ্যাপারেলস, বেক্সিমকো ফ্যাশন, বেক্সটেক্স গার্মেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড নিটওয়্যার, এসেস ফ্যাশন, ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল, কজি অ্যাপারেলস, কসমো পলিটান অ্যাপারেলস, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রি, পিং মেকার গার্মেন্ট, প্লাটিনাম গার্মেন্ট, অ্যাপোলো অ্যাপারেলস, পিয়ারলেস গার্মেন্ট, অটামলুফ অ্যাপারেলস, উইন্টার স্পিরিন্ট গার্মেন্ট, মিডওয়েস্ট গার্মেন্ট লিমিটেড, স্পিরিংফুল অ্যাপারেলস, শাইনপুকুর গার্মেন্ট, কাঁচপুর অ্যাপারেল, আরবান ফ্যাশন্স, সানসস্টার বিজনেস, ফারইস্ট বিজনেস এবং ইন্টারন্যাশনাল নিটিং অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেড এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
এই দুটি গ্রুপের কুঋণ দিয়েই পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেলের মতো বিশাল প্রকল্পের ব্যয় মেটানো সম্ভব।


শীর্ষ ১০০ এর তালিকাভুক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহ-
    আরামিট গ্রুপ: আরামিট সিমেন্টের ১০৬১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৮৬৬ কোটি।

    রূপায়ণ গ্রুপ: রূপায়ণ হাউজিং স্টেটের ৪ হাজার ১১১ কোটি ঋণের মধ্যে খেলাপি ১৪৯৮ কোটি।

    নাবিল গ্রুপ: এজে ট্রেডের ১৬৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ১৩৩৪ কোটি।

    সাইফ পোর্ট হোল্ডিংস: ১১৭৬ কোটি টাকা (মালিক রুহুল আমিন তরফদার)।

    অ্যাপোলো ইস্পাত: ১০২৩ কোটি টাকা।

    সিকদার গ্রুপ: পাওয়ারপ্যাক মাটিয়ারা কেরানীগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টের ১০০০ কোটি এবং পাওয়ারপ্যাক মাটিয়ারা জামালপুর পাওয়ার প্ল্যান্টের ১৩০৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৬২৯ কোটি।

    আবদুল মোনেম গ্রুপ: ২৩৭৮ কোটি ঋণের মধ্যে খেলাপি ৬৮১ কোটি।

    রংধনু গ্রুপ: রংধনু বিল্ডার্সের ১৬৭৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৮৮৯ কোটি টাকা।

    ওরিয়ন গ্রুপ: ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিংয়ের ২৩৭১ কোটি ঋণের মধ্যে খেলাপি ৮৮২ কোটি।

    কসমস গ্রুপ: কসমস কমোডিটিসে ৬৭২ কোটি।

    ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড: ২২৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৬৭১ কোটি।

    মাইশা প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট (সাবেক এমপি আসলামুল হক): ৬৯৫ কোটি।

    কেয়া কসমেটিকস: ২ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।


    ক্রিসেন্ট গ্রুপ: ক্রিসেন্ট ফ্যাশন (১৩৮৮ কোটি), লেক্সকো লিমিটেড (৬৮৩ কোটি), রূপালী কম্পোজিট লেদার (৮৭৬ কোটি)।

    এনন টেক্স গ্রুপ: সুপ্রভ কম্পোজিট নিট (১৩৫৪ কোটি), গ্লাক্সি সোয়েটার (১১৪৬ কোটি), সুপ্রোভ স্পিনিং (৮৩১ কোটি), সুপ্রোভ রোটর স্পিনিং মিল (৬৫২ কোটি)।

    জজ ভুইয়া গ্রুপ: রিমেক্স ফুটওয়্যার (২৬১৪ কোটি ঋণের মধ্যে খেলাপি ১১১৩ কোটি), জাকিয়া কর্টনেক্স (৯৪৫ কোটি)।

    হাবিব গ্রুপ: হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনাল (১৬৩৮ কোটি)।

    মাহিন এন্টারপ্রাইজ (আশিকুর রহমান লস্কর): ৭৪৪ কোটি।

    এফএমসি ডকইয়ার্ড (ইয়াসিন রহমান): ১২৭৪ কোটি।

    মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স: ৯৪৮ কোটি।

    রানাকা সোহেল কম্পোজিট (রুট গ্রুপ): ৯৩১ কোটি।

    এসকর্প অ্যাপারেলস (আবু নাইম মাহামুদ সালেহীন): ৯২১ কোটি।

    মেরিন ভেজিটেবল অয়েল (নুরজাহান গ্রুপ): ৯১৮ কোটি।

    বে সিটি অ্যাপারেলস (হাসান মাহমুদ সানাউল হক): ৮৯৬ কোটি।

    হোয়াইট মে অ্যাপারেলস (মাকসুদুর রহমান): ৮৭২ কোটি।

    ক্রিসেন্ট লেদার: ৮৫৫ কোটি।

    স্কাইনেট অ্যাপারেলস: ৭৯০ কোটি।

    রানাকা ডেনিম টেক্সটাইল মিলস (রুট গ্রুপ): ৭৮৪ কোটি।

    রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল (সাদমুসা গ্রুপ): ৭৮৩ কোটি।

    সিমরান কম্পোজিট (পিরান টেকনোলজি গ্রুপ): ৭৮০ কোটি।

    জ্যাকওয়ার্ড নিটিং: ৭৭৯ কোটি।

    লিটুন ফ্যাব্রিকস (নজরুল ইসলাম ঢালি): ৭৬৯ কোটি।

    তাসমিন ফ্লাওয়ার মিলস (নুরজাহান গ্রুপ): ৭৫৩ কোটি।

    এসএম স্টিল রিরোলিং মিলস (রতনপুর গ্রুপ): ৭৫৩ কোটি।

    এসএম জুট ট্রেডিং (এসএম সাজ্জাদ হোসেন): ৭৪৯ কোটি।

    জুট টেক্সটাইল মিলস (রোকেয়া রহমান): ৭২৫ কোটি।

    দ্য ডেল্টা কম্পোজিট (ডেল্টা গ্রুপ): ৭২৬ কোটি।

    ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিন (আব্দুর রশিদ ভুইয়া): ৭১২ কোটি।

    বি আর স্পিনিং মিলস (বজলুর রহমান): ৭০৯ কোটি।

    সাদমুসা ফ্যাব্রিকস (সাদমুসা গ্রুপ): ৬৯৫ কোটি।

    গ্রান্ড ট্রেডিং (মোয়াজ্জেম হোসেন): ৬৬৯ কোটি।

    ব্রডওয়ে রিয়েল স্টেট (মো. ইসমাইল): ৬৬৩ কোটি।

    বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ (এমএ বারী): ৬৬২ কোটি।

    দ্য ডেল্টা স্পিনিং মিলস (ডেল্টা গ্রুপ): ৬৫৮ কোটি।

    সিদ্দিক ট্রেডার্স (আবু সাঈদ চৌধুরী): ৬৪৬ কোটি।

    এশিয়ান এডুকেশন (এশিয়ান গ্রুপ): ৬৪৬ কোটি।

    ডলি কন্সট্রাকশন (নাসির উদ্দিন): ৬২৮ কোটি।

    মাদারীপুর টেক্সটাইল মিলস (মো. ইউসুফ বাবু): ৬১৮ কোটি।

    কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম (অটোবি গ্রুপ): ৬১৭ কোটি।

    এসহান স্টিল রিরোলিং (এসহান গ্রুপ): ৬০৬ কোটি।

    বন্দরপুর স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ (সিরাজুল ইসলাম): ৫৯০ কোটি।

    কম্পিউটার সোর্স লিমিটেড (এএইচএম মাহফুজুল আরিফ): ৫৮৭ কোটি।

    আরডেন্ট সিস্টেম: ৫৮৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।


বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তালিকা কেবল একক প্রতিষ্ঠানের 'ফান্ডেড' (নগদ টাকা) খেলাপি ঋণকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর বাইরে একই গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে আরও খেলাপি ঋণ এবং 'নন-ফান্ডেড' (এলসি খোলা ও ব্যাংক গ্যারান্টি) ঋণ রয়েছে।
এছাড়া উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে থাকা বেশকিছু ঋণ এই হিসাবে ধরা হয়নি। অর্থাৎ, যদি নন-ফান্ডেড এবং স্থগিতাদেশে আটকে থাকা ঋণগুলো হিসাবে আনা হয়, তবে এই ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জুন মাস পর্যন্ত হিসাব করলে সব প্রতিষ্ঠানই শতভাগ খেলাপি হবে।


ঋণখেলাপির এমন ভয়াবহ অবস্থার জন্য কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপে ঋণ বিতরণকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, "তারা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন। ক্ষমতার দাপটে এসব ঋণ নিয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। তারা জানতেন ঋণ নিলে ফেরত দিতে হবে না। তারা কালোটাকা এবং শক্তি দিয়ে বছরের পর বছর আইনি প্রক্রিয়া এড়াতে সক্ষম।"


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জামানত ছাড়া যে ব্যাংক ঋণ দিয়েছে, ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কোন বিবেচনায় এত বড় ঋণ দেওয়া হলো তা জবাবদিহিতার আওতায় আনতে না পারলে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ