হাসছেন, কথা বলছেন, চলাফেরা করছেন- তবু একা বোধ করছেন!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের আধুনিক সমাজে দেখা যাচ্ছে, মানুষ জনসমাগমে ঘেরা থাকলেও, মানসিকভাবে একাকীত্ব অনুভব করছে। এই একাকীত্ব এখন আর শুধু মনোভাবের বিষয় নয়, এটি একটি জটিল সামাজিক ও মানসিক সমস্যা হিসেবে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন—যাকে 'আচরণগত নিঃসঙ্গতা' (Behavioral Loneliness) বলা হয়।
আচরণগত নিঃসঙ্গতার মূল কথা হলো—ব্যক্তি সামাজিকভাবে যোগাযোগ করলেও, তার সেই সম্পর্কগুলো মানসিক প্রশান্তি বা আত্মিক সংযোগ দিতে পারে না। অর্থাৎ, মানুষ আঙিনায় হেলান দিয়ে বসেছে, কিন্তু তার মন ভিড়ের মাঝে একাকী। এই সমস্যা কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি একটি সামাজিক সংকট যা আধুনিক জীবনের প্রযুক্তিনির্ভরতা, দ্রুত গতি এবং পরিবর্তিত জীবনধারার সঙ্গে জড়িত।
আচরণগত নিঃসঙ্গতা বাড়ার কারণ :
বর্তমান যুগে প্রযুক্তির অগ্রগতি যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনই এটি আমাদের সামাজিক সম্পর্কের প্রকৃত গভীরতা হ্রাস করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, মেসেজিং অ্যাপ আর অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ বেড়েছে, কিন্তু 'মুখোমুখি' সম্পর্কের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, স্নেহ-অনুভূতি এবং আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে।
ব্যস্ত কর্মজীবন, শহুরে জীবনের চাপ, সময়ের অভাব—এসবও মানুষের প্রকৃত সংযোগে বাধা সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত ডিজিটাল ব্যবহার 'কনট্যাক্ট ইলুসন' তৈরি করে, যেখানে মানুষ সামাজিক হলেও একাকীত্ব অনুভব করে।
বিজ্ঞান যা বলে-
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা গেছে, আচরণগত নিঃসঙ্গতা দীর্ঘদিন ধরে চললে তা বিষণ্নতা, উদ্বেগ, এবং মানসিক চাপের প্রধান কারণ হতে পারে। এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে দেয়, যা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন শারীরিক অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়।
মস্তিষ্কের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, মানুষের 'সোশ্যাল ব্রেন' অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য বিশেষ অংশ রয়েছে। যখন এই অংশের সঙ্গে যথাযথ সংযোগ হয় না, তখন মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং আচরণগত নিঃসঙ্গতা সৃষ্টি হয়।
প্রভাব:
ব্যক্তিগত জীবনে এই নিঃসঙ্গতা মানুষের আত্মবিশ্বাস, কর্মক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয়। কর্মক্ষেত্রে সমবেদনা ও সহযোগিতা কমে গেলে উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবারেও দূরত্ব বেড়ে যায়, যার ফলে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাব বাড়ে।
সমাধানের পথ:
আচরণগত নিঃসঙ্গতা কাটাতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহার সীমিত করতে হবে এবং প্রকৃত সামাজিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো, বন্ধুদের সঙ্গে গভীর আলাপ, কর্মক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।
মনোবিজ্ঞানে 'মাইন্ডফুলনেস' বা সচেতনতা চর্চা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করাও সাহায্য করে নিঃসঙ্গতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।
যদিও আজকের পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তির আধিপত্যে, সেখানে মানুষের প্রকৃত সংযোগ হারানো মানে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হারানো। আচরণগত নিঃসঙ্গতা আমাদের চেতনায় এতোদিন অদৃশ্য থেকেছে, এখন সময় এসেছে এই সমস্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার। কেবলমাত্র একা নয়, একে অপরকে 'বুঝে' চললেই এই আধুনিক যুগের একাকীত্বের ছায়া দূর করা সম্ভব।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।