হাতের ঝিনঝিনে ভাব আর অবশতা-এটা শুধু ক্লান্তি না, হতে পারে ভয়ঙ্কর 'কার্পাল ফাঁদ'!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
কার্পাল টানেল সিনড্রোম (Carpal Tunnel Syndrome - CTS) হলো এক ধরনের স্নায়ুতন্ত্রের সংকোচনজনিত রোগ, যা হাতের কব্জির মধ্য দিয়ে যাওয়া 'কার্পাল টানেল' নামক সংকীর্ণ নালীতে থাকা মেডিয়ান স্নায়ুর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণে ঘটে। এই চাপ হাতের বিভিন্ন আঙ্গুলে অনুভূতি, শক্তি এবং গতি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
কার্পাল টানেল কী এবং এর গঠন-
হাতে কব্জির নিচে একটি ছোট, সংকীর্ণ চ্যানেল বা নালী থাকে, যাকে 'কার্পাল টানেল' বলা হয়। এই টানেলের মাধ্যমে মেডিয়ান নার্ভ (Median nerve) এবং নয়টি ফ্লেক্সর টেনডন (flexor tendons) হাতের আঙুলগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যায়। টানেলের দেয়াল গঠিত থাকে হাড় ও কার্পাল বোন (carpal bones) দ্বারা, এবং উপরের দিকে 'ফ্লেক্সর রেটিনাকুলাম' নামে শক্তিশালী একটি ফাইব্রাস টিস্যু থাকে।
যখন এই টানেলটি ছোট হয়ে যায় বা টিস্যুগুলো ফুলে ওঠে, তখন নার্ভের ওপর চাপ পড়ে। ফলে নার্ভের সংকেত সঠিকভাবে হাতের আঙ্গুলে পৌঁছাতে পারে না।
স্নায়ু (Median nerve) ও তার ভূমিকা-
মেডিয়ান নার্ভ মূলত হাতের প্রথম তিনটি আঙুল এবং অংশত চতুর্থ আঙুলের অনুভূতি এবং গঠন নিয়ন্ত্রণ করে। এটি মস্তিষ্ক থেকে সঙ্কেত নিয়ে আসে হাতের স্পর্শ ও গতি অনুভবের জন্য। এই নার্ভে চাপ পড়লে হাতের স্পর্শ, শক্তি এবং সূক্ষ্ম গতিবিধি বাধাগ্রস্ত হয়।
CTS এর কারণ ও ঝুঁকি-
- পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ: বারবার একই হাতের আন্দোলন (যেমন: টাইপিং, মাউস ক্লিক করা, জিনিস ধরার কাজ) কার্পাল টানেলের টিস্যু ফোলা ও সঙ্কুচিত করতে পারে।
- হাতের অবস্থান: দীর্ঘ সময় কব্জি বাঁকানো অবস্থায় কাজ করলে চাপ বাড়ে।
- গর্ভাবস্থা ও হরমোনাল পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় শারীরিক ফ্লুইড বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে টিস্যু ফুলে যায়।
- বয়স ও লিঙ্গ: ৩০-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, নারীদের ঝুঁকি পুরুষের চেয়ে কিছুটা বেশি।
- রোগ: ডায়াবেটিস, রুমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, থাইরয়েড ডিসফাংশন ইত্যাদি রোগ CTS এর কারণ হতে পারে।
- আঘাত: কব্জিতে সোজাসুজি আঘাত বা ভাঙ্গন থাকলে টানেল সংকীর্ণ হতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গের বিস্তারিত:
- প্রাথমিক লক্ষণ: হাত ও আঙুলে হালকা ঝিনঝিনে ভাব, চুলকানি, অস্বস্তি বিশেষত রাতে বেশি অনুভূত হয়।
- অগ্রসর অবস্থায়: ধীরে ধীরে আঙুলের শক্তি কমে যায়, জিনিস ধরে রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে।
- হাতের গঠন পরিবর্তন: দীর্ঘ সময় untreated থাকলে হাতের 'অ্যাবডাক্টর পলিসিস ব্রেভিস' মাসলটি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে, ফলে আঙ্গুলগুলো দুর্বল ও সঙ্কুচিত হয়।
সংবেদনশীলতা হারানো: স্পর্শের অনুভূতি কমে যাওয়া।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি :
১. নির্ণয় পদ্ধতি:
- শারীরিক পরীক্ষা: বিশেষভাবে 'টাইনেল সাইন' (Tinel's sign) ও 'ফ্যালেন টেস্ট' (Phalen's test) করা হয়।
- ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি (EMG) ও নাভেল কনডাকশন স্টাডি: স্নায়ুর সংকেত প্রবাহের গতি মাপা হয়।
- আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও MRI: টিস্যুর ফোলা বা টানেলের সংকীর্ণতা যাচাই করা।
২. চিকিৎসার ধাপ:
প্রাথমিক চিকিৎসা:
- কাজের পরিবেশে পরিবর্তন ও হাত বিশ্রাম
- হাত সোজা রাখার জন্য স্প্লিন্ট বা ব্রেস ব্যবহার
- ব্যথা কমাতে ও ফোলা কমাতে NSAIDs (যেমন আইবুপ্রোফেন)
- হালকা ফিজিওথেরাপি ও হাতের ব্যায়াম
মাঝারি থেকে গুরুতর অবস্থায়:
- স্টেরয়েড ইনজেকশন দিয়ে ফোলা কমানো
- দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলে শল্যচিকিৎসা (কার্পাল টানেল মুক্তি সার্জারি) প্রয়োজন হতে পারে। এতে ফ্লেক্সর রেটিনাকুলাম কাটা হয় যাতে নার্ভের ওপর চাপ কমে।
প্রতিরোধ ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন :
- হাতের বিশ্রাম: কাজের মাঝে নিয়মিত বিরতি নেয়া
- হাতের ব্যায়াম: বিশেষজ্ঞের নির্দেশে কব্জি ও আঙুলের জন্য হালকা স্ট্রেচিং
- সঠিক কাজের পরিবেশ: হাত ও কব্জি সোজা রাখার জন্য যথাযথ চেয়ার ও ডেস্ক ব্যবস্থাপনা
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন CTS ঝুঁকি বাড়ায়, তাই নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস গুরুত্বপূর্ণ।
- দীর্ঘক্ষণ একই অবস্থানে কাজ না করা
বৈজ্ঞানিক গবেষণার গুরুত্ব :
বর্তমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে CTS এর প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক নির্ণয় ও সফল চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে হাতের স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতি রোধ করা যায়। ফলে কর্মদক্ষতা বজায় থাকে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
কার্পাল টানেল সিনড্রোম আধুনিক জীবনের কর্মসংস্কৃতির এক চ্যালেঞ্জ। তবে সঠিক সচেতনতা, নিয়মিত বিশ্রাম ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা মেনে চললে এই সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। হাতের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।