শিক্ষা না শাস্তি? মানসিক স্বাস্থ্যে ক্ষত রেখে যাচ্ছে দেশের পরীক্ষার চাপ

শিক্ষা না শাস্তি? মানসিক স্বাস্থ্যে ক্ষত রেখে যাচ্ছে দেশের পরীক্ষার চাপ
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

দেশের কোটি-কোটি তরুণ ও তরুণী একসময় জীবনের এক বড় পর্ব হিসেবে দেখে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাকে। এই পরীক্ষার ফলাফল তাদের ভবিষ্যতের দরজা খুলবে বলে ধারণা রয়েছে সমাজে। কিন্তু গত কয়েক বছরে রেজাল্ট ঘোষণার পরপরই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনায় উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। প্রশ্ন জাগে, শুধু পরীক্ষার ফলাফল কি এতটাই বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে? না কি এই চাপের পেছনে লুকিয়ে আছে আরো গভীর একটি মানসিক সংকট?

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নম্বর নির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। পরিবারের ও সমাজের উচ্চ প্রত্যাশা, পাশাপাশি নিজের সঙ্গে নিজের তুলনা—এসব একত্রিত হয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবলমাত্র ভালো নম্বর না পাওয়াই নয়, বরং 'পরফেকশনিজম' বা অতিরিক্ত শুদ্ধতার পিছু ধাওয়া ও নিজেদের প্রতি অতিরিক্ত দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের মাত্রা বাড়ায়। অনেক সময় গড়গড় ফলাফল পাওয়া শিক্ষার্থীরাও এই মানসিক চাপের শিকার হয়ে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

 

যেকারণে তরুণেরা এতটা ভেঙে পড়ে-

বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা গেছে, কিশোরদের মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ এবং যুক্তিবুদ্ধি অংশ পুরোপুরি বিকশিত হয় না। ফলে আবেগের ঝোঁক বেশি এবং চাপ সামলানো কমজোরি হয়।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো—সমাজ ও পরিবারে প্রচলিত 'তুলনা' ও 'প্রতিযোগিতা' শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেদের মূল্যায়নকে বিকৃত করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের সাফল্যের ছবি দেখে নিজেকে নিচু মনে হওয়া আজকের বাস্তবতা।


সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের ভূমিকা-

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশে শিক্ষা শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির মাধ্যম নয়, পরিবারের সম্মানের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত। বাবা-মা, অভিভাবকরা অনেক সময় নিজের প্রত্যাশার কারণে সন্তানদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেন। সেই চাপই তরুণদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।

অর্থাৎ, চাপের উৎস কেবল শিক্ষাব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং পারিবারিক, সামাজিক এবং মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এর বিশ্লেষণ জরুরি।


কিভাবে রোধ করা যায় এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলো?

১. শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার:
নম্বরের পরিবর্তে শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ, দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। পরীক্ষার ফলাফল নয়, শেখার প্রক্রিয়া এবং মনোভাবকে গুরুত্ব দিতে হবে।

 

২. মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা:
স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচি চালু করতে হবে। বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ ও কাউন্সেলিং সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি।

 

৩. পারিবারিক সহায়তা:
অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের ফলাফলের প্রতি চাপ না দিয়ে তাদের প্রচেষ্টা ও মানসিক অবস্থার প্রতি সহানুভূতি দেখানো। আলোচনা ও বোঝাপড়া বাড়ানো খুবই প্রয়োজন।

 

৪. সোশ্যাল মিডিয়া ও চাপ:
তরুণদেরকে সোশ্যাল মিডিয়ার 'ফিল্টারড' ছবি ও বাস্তব জীবনের পার্থক্য বোঝানো দরকার। মানসিক চাপ কমাতে 'ডিজিটাল ডিটক্স' বা ইন্টারনেট ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

 

শেষ কথা, তরুণদের জীবনের মূল্য কোনো পরীক্ষার ফলাফলে সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যেকেরই একটি স্বতন্ত্র গতি, স্বপ্ন ও সম্ভাবনা থাকে। সমাজের দায়িত্ব তাদের সেই সম্ভাবনার বিকাশে সহায়তা করা, তাদের চাপ থেকে মুক্তি দিয়ে মানসিক শক্তি জোগানো।

একটি সুস্থ ও সচেতন সমাজ গড়ে তোলা গেলে আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা আমরা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারব।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ