মৌমাছির হুলে মিলল ক্যান্সার ঠেকানোর চাবিকাঠি-মেলিটিনের অদ্ভুত শক্তি আবিষ্কারে বিস্মিত বিজ্ঞানীরা

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিষ মানেই বিপদ-এই ধারণা বহুদিনের। কিন্তু বিজ্ঞান সেই ধারণাকে পাল্টে দিচ্ছে বারবার। অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষকের দাবি, মৌমাছির হুলে থাকা বিষ শুধু যন্ত্রণাদায়কই নয়, তা ব্রেস্ট ক্যান্সারের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধরণের কোষকে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে ধ্বংস করে দিতে পারে। আর আশার কথা হলো-এটি আশেপাশের সুস্থ কোষগুলোকে প্রায় অক্ষত রাখে।
মৌমাছির বিষে রয়েছে একটি অত্যন্ত সক্রিয় রাসায়নিক যৌগ—মেলিটিন (Melittin)। এটি একটি পলিপেপটাইড, অর্থাৎ অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি একটি প্রোটিন জাতীয় উপাদান। এটি মৌমাছির প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অংশ হলেও, গবেষণাগারে এটি এখন টিউমার কোষের ধ্বংসযন্ত্রে রূপ নিয়েছে।
গবেষণায় বিশেষভাবে লক্ষ্য করা হয়েছে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সেই দুই ধরণে, যেগুলোকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সবচেয়ে প্রতিরোধী ও প্রাণঘাতী ধরা হয়:
১। ট্রিপল-নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার (TNBC)
২। HER2-পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার
এই দুটি ক্যান্সারে প্রচলিত থেরাপি যেমন হরমোন থেরাপি বা HER2 ইনহিবিটর অনেক সময়ই কাজ করে না। ফলে এগুলোর চিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন এবং মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি।
মেলিটিন এই কোষগুলোর গায়ে থাকা ক্যান্সার স্পেসিফিক প্রোটিন রিসেপ্টরকে টার্গেট করে, এবং কোষের মেমব্রেনে ছিদ্র তৈরি করে দেয়। এর ফলে কোষের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ দ্রুত ভেঙে পড়ে, এবং কোষ ধ্বংস হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মেলিটিন প্রয়োগের ২০ মিনিটের মধ্যে এটি ক্যান্সার কোষে থাকা
⇨ EGFR (Epidermal Growth Factor Receptor)
⇨ HER2 (Human Epidermal Growth Factor Receptor 2)
- এদের কার্যক্ষমতা বন্ধ করে দেয়। এরা হলো সেই রাসায়নিক সিগন্যাল, যেগুলোর সাহায্যে ক্যান্সার কোষ দ্রুত বৃদ্ধি ও বিভাজন করে। এছাড়াও মাত্র ৬০ মিনিটের মাথায় মেলিটিন অনেক কোষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়ে পড়ে।
গবেষণার পদ্ধতি-
⇨ মানব ক্যান্সার কোষের ল্যাব সংস্করণে মেলিটিন প্রয়োগ করা হয়।
⇨ সুস্থ কোষের সঙ্গেও মেলিটিনের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষণার ফলাফল দেখায়, মেলিটিন ক্যান্সার কোষের প্রতি অত্যন্ত নির্দিষ্টভাবে কাজ করে এবং সুস্থ কোষে ন্যূনতম প্রভাব ফেলে। এই গবেষণাটি ২০২০ সালে npj Precision Oncology নামক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি-
মেলিটিন অত্যন্ত সক্রিয় একটি যৌগ। এটি যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সুস্থ কোষের মেমব্রেনেও ছিদ্র করতে পারে, ফলে দেখা দিতে পারে ব্যাপক কোষীয় ক্ষতি, প্রদাহ বা এলার্জি প্রতিক্রিয়া।
গবেষকরা বলছেন, সঠিক ডোজিং, টার্গেটিং এবং ডেলিভারি সিস্টেম না থাকলে এটি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ।
সমাধান যেভাবে খোঁজা হচ্ছে?
বর্তমানে গবেষণা চলছে মেলিটিনকে এমন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রয়োগ করার, যা সরাসরি ক্যান্সার কোষে পৌঁছাতে পারে, যেমন:
⇨ Nanoparticle Delivery Systems: যেখানে মেলিটিন এক ধরনের কৃত্রিম ক্যাপসুলে ভরে শুধুমাত্র টিউমার এলাকায় পাঠানো হয়।
⇨ Antibody-Conjugated Melittin Therapy: যেখানে মেলিটিনকে এক ধরনের অ্যান্টিবডির সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা কেবল ক্যান্সার কোষকে চিনে সেই কোষেই মেলিটিন ছাড়ে।
⇨ Controlled-release Hydrogel Systems: যাতে করে মেলিটিন ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট টিস্যুতে ছড়ায়।
মেলিটিন ও মৌমাছির বিষ থেকে তৈরি ওষুধ ভবিষ্যতে কেবল ব্রেস্ট ক্যান্সার নয়, আরও অনেক ধরনের টিউমারের বিরুদ্ধেও ব্যবহার হতে পারে বলে আশা করছেন গবেষকরা। ইতিমধ্যেই কিছু প্রাথমিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মেলানোমা, ওভারিয়ান ক্যান্সার, এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারেও এর কার্যকারিতা রয়েছে।
যেখানে যন্ত্রণা, সেখানেই প্রতিরক্ষা-এই নীতিতেই কাজ করছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। মৌমাছির হুল যে শুধু ব্যথা দেয়, তা নয়। সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে এমন একটি উপাদান, যা পৃথিবীর সবচেয়ে মরণব্যাধির বিরুদ্ধেও প্রতিষেধক হতে পারে। আজ যেটি গবেষণাগারের পরীক্ষায়, আগামী কাল সেটিই হতে পারে হাজারো মানুষের জীবনরক্ষার অস্ত্র।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।