কেটে যাওয়া অঙ্গ গজাবে আবার? প্রকৃতির রহস্য থেকেই আসছে চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
হারানো হাত বা পা যদি নতুন করে গজিয়ে উঠত! বিষয়টা শুনতে যতই অবাস্তব মনে হোক, প্রকৃতিতে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। আর সেই ঘটনাটিই এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামনে এক নতুন দিগন্তের পথ খুলে দিচ্ছে।
ছোটবেলা থেকেই আমরা সবাই একবার না একবার হলেও টিকটিকিকে দেখে থাকি-আরো দেখেছি, ভয় পেলে কিংবা আঘাত পেলে তারা তাদের লেজ ফেলে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই সেই লেজ আবার নতুন করে গজিয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়া যে কেবল কৌতূহলের বিষয় নয়, তা আজ প্রমাণিত। আসলে টিকটিকির এই ক্ষমতা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে এক অসাধারণ রিসার্চ মডেল হয়ে উঠেছে।
লেজ গজানোর জৈবিক প্রক্রিয়া:
টিকটিকির লেজ পুনরুদ্ধারের পেছনে রয়েছে নিখুঁতভাবে সংগঠিত কোষীয় কর্মকাণ্ড। যখন লেজটি কেটে যায়, তখন টিকটিকির শরীর "Blastema" নামে একটি কোষগুচ্ছ তৈরি করে, যেটি মূলত স্টেম সেল ও প্রোলিফারেটিভ সেলের একধরনের মিশ্রণ।
এই কোষগুলো হঠাৎ করে অতিমাত্রায় বিভাজিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন ধরণের কোষে রূপান্তরিত হয়-যেমন:
⇨ Osteoblast (হাড় গঠনের কোষ)
⇨ Chondrocyte (কার্টিলেজ কোষ)
⇨ Myocyte (মাংসপেশির কোষ)
⇨ Neural progenitor cells (স্নায়ুতন্ত্র গঠনের কোষ)
এই কোষগুলোর সম্মিলিত কাজেই গঠিত হয় পুরো নতুন একটি লেজ-হাড়, রক্তনালী, স্নায়ু, চামড়া সহ।
মানুষের শরীর: সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার দ্বন্দ্ব
মানুষের শরীরেও আছে স্টেম সেল, যা বহুগুণে বিভাজন ও রূপান্তরের ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই ক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবে সীমিত। ত্বকে ছোট কাটা লাগলে তা ঠিক হয়ে যায়, হাড় ভাঙলেও সময়ের সঙ্গে জোড়া লাগে। তবে সম্পূর্ণ একটি হাত, পা, বা হৃদপিণ্ড যদি কেটে যায়, সেটা পুনরায় গজানোর ক্ষমতা মানুষের দেহে নেই।
এই সীমাবদ্ধতার কারণ মূলত তিনটি:
⇨ Blastema গঠনের অক্ষমতা – মানুষ সেই ধরণের কোষগুচ্ছ তৈরি করতে পারে না।
⇨ জিনগত নিয়ন্ত্রণ জটিলতা – কোষ বিভাজন ও রূপান্তর মানবদেহে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, যাতে ক্যান্সারের ঝুঁকি না থাকে।
⇨ ইমিউন সিস্টেমের বাধা – মানুষের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কোষীয় রিজেনারেশন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
গবেষণার সর্বশেষ দিগন্ত:
⇨ Wnt Signaling Pathway:
এই জিনগত সিগনালিং সিস্টেম টিকটিকির লেজ গজানোর সময় খুবই সক্রিয় থাকে। এটি কোষ বিভাজন ও নতুন কোষ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। গবেষকরা এখন মানুষের কোষে কৃত্রিমভাবে Wnt pathway অ্যাক্টিভেট করার চেষ্টা করছেন-স্টেম সেলের মেরামত ক্ষমতা বাড়াতে।
⇨ microRNA এর ভূমিকা:
টিকটিকির রিজেনারেশন প্রক্রিয়ায় microRNA-133a, 133b এবং 206 নামক ক্ষুদ্র জিনগত উপাদানগুলো সুনির্দিষ্ট কোষ তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের কোষে এই microRNA কৃত্রিমভাবে প্রয়োগ করে গবেষকরা কিছু সাফল্য পেয়েছেন-বিশেষ করে কোষ রূপান্তর ও টিস্যু রিজেনারেশনের ক্ষেত্রে।
⇨ Epigenetics ও CRISPR প্রযুক্তি:
গবেষণায় উঠে এসেছে যে কোষীয় স্মৃতি (epigenetic memory) মুছে দিলে কোষগুলো আবার প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে গিয়ে নতুন কোষ তৈরি করতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ব্যবহার হচ্ছে জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি CRISPR/Cas9, যা জিনকে কাটাছেঁড়া করে পুনরায় সেট করতে সাহায্য করে।
ইঁদুর ও অন্যান্য প্রাণীতে পরীক্ষা:
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ইঁদুরের শরীরে টিকটিকির মতো blastema-জাত কোষ ও Wnt pathway প্রয়োগ করে কিছু ক্ষেত্রে আংশিকভাবে আঙুলের অগ্রভাগ পুনর্গঠিত হয়েছে।
এছাড়াও অ্যাক্সোলটল (Axolotl) নামে একটি জলে থাকা স্যালামান্ডার প্রজাতির জীব রয়েছে, যাদের পুরো পা, এমনকি হৃদপিণ্ডের অংশ পর্যন্ত গজিয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা এই প্রাণীর জিন ও রিজেনারেটিভ পদ্ধতিও এখন মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করছেন।
Lab-grown organs:
⇨ বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হলো ল্যাবরেটরিতে অঙ্গ উৎপাদন বা "bioengineered organs" তৈরির চেষ্টা।
⇨ স্টেম সেল থেকে তৈরি হচ্ছে mini organoids (কিডনি, লিভার, ব্রেন টিস্যুর ছোট সংস্করণ)
⇨ বায়োপ্রিন্টিং প্রযুক্তির মাধ্যমে 3D printer ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম হৃদপিণ্ডের কাঠামো
⇨ মানুষের রোগীর শরীর থেকে স্টেম সেল নিয়ে নিজের মতো অঙ্গ তৈরি করায় অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর ইমিউন রিজেকশনের সম্ভাবনা কমে
তবে এগুলো এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে, এবং বড় পরিসরে কার্যকর ব্যবহারের জন্য সময় ও প্রযুক্তির উন্নয়ন দরকার।
টিকটিকির লেজ আমাদের শেখাচ্ছে, কীভাবে প্রকৃতি নিজেই নিজের চিকিৎসক। আর বিজ্ঞান সেই শিক্ষাকে রূপ দিতে চায় মানবজীবনের উন্নত ভবিষ্যতে। আজ হারানো অঙ্গ গজানো হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু আগামী ২০–৩০ বছরের মধ্যে এটি আর অলৌকিক কিছু থাকবে না—এমনটাই বিশ্বাস করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমরা এখন এক নতুন চিকিৎসা বিপ্লবের দরজায় দাঁড়িয়ে, যেখানে একদিন হয়তো অপারেশনের বদলে জিনগত প্রোগ্রামিং দিয়েই শরীরের হারানো অংশ ফিরিয়ে আনা যাবে। আর সেই চাবিকাঠি-একটি ক্ষুদ্র, নির্বিকার টিকটিকির লেজেই।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।