জানুন মাতৃত্ব-পিতৃত্বের মনস্তাত্ত্বিক রহস্য, যা বদলে দিতে পারে সম্পর্কের ধারা!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানব জীবনের সবচেয়ে প্রগাঢ় ও জটিল সম্পর্কগুলোর মধ্যে একটি হলো সন্তান ও অভিভাবকের সম্পর্ক। এই সম্পর্কের গভীরে রয়েছে জৈবিক পরিবর্তন, মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া ও সামাজিক ভূমিকা, যা একসাথে সন্তানদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশকে প্রভাবিত করে।
মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের জৈবিক ভিত্তি
* গর্ভাবস্থার হরমোনাল পরিবর্তন-
মাতৃত্বের সময় মা-মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন (bonding hormone), প্রোল্যাকটিন ও অন্যান্য হরমোনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
অক্সিটোসিন "স্নেহ ও বন্ধনের হরমোন" হিসেবে কাজ করে, যা মাতাকে শিশুর প্রতি অনুভূতিতে আবদ্ধ করে।
* পিতার হরমোনাল পরিবর্তন-
গবেষণায় দেখা গেছে, বাবাদের শরীরেও সন্তানের জন্মের পর টেস্টোস্টেরন হ্রাস পেতে পারে, যা তাদের মাতৃত্বসুলভ আচরণে সাহায্য করে। একই সাথে অক্সিটোসিন ও ভ্যাসোপ্রেসিন বাবাদের সংবেদনশীল ও যত্নশীল করে তোলে।
* মস্তিষ্কের নিউরাল প্লাস্টিসিটি-
সন্তান জন্মানোর পর মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে অ্যামিগডালা (ভয় ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ), হিপোক্যাম্পাস (স্মৃতি ও শেখার কেন্দ্র) ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সিদ্ধান্তগ্রহণ) পরিবর্তিত হয়।
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব-
প্রতিটি শিশুর জীবনে বিনিয়োগকৃত ভালোবাসা ও স্নেহ তাদের আবেগগত নিরাপত্তার ভিত্তি গড়ে তোলে। বিজ্ঞানীরা আবেগগত বন্ধনকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন:
* নিরাপদ আবদ্ধতা (Secure Attachment): মা-বাবার সহানুভূতিশীল আচরণে শিশুর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
* অসুরক্ষিত আবদ্ধতা (Insecure Attachment): মা-বাবার অবহেলা বা অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ শিশুর মানসিক সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
* অসংলগ্ন আবদ্ধতা (Disorganized Attachment): শিশুর জন্য নিরাপত্তাহীনতার সংকেত, যা ভবিষ্যতে ব্যক্তিত্ব বিকাশে সমস্যা তৈরি করে।
দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগ-
মাতৃত্ব এবং পিতৃত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হলো দায়িত্ব ও আত্মত্যাগের প্রবণতা। অন্তর্নিহিতভাবে, মা-বাবা সন্তানদের জন্য নিজেদের প্রয়োজন ও ইচ্ছাকে পিছনে ফেলে দেয়। এটি জৈবিকভাবে "অল্ট্রুয়িজম" নামে পরিচিত এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান দ্বারা সমৃদ্ধ।
মাতার ও পিতার পার্থক্যপূর্ণ আচরণ-
⇨ মাতার ভূমিকা: অধিক স্নেহপূর্ণ, স্নেহময়, শিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণে নিবেদিত।
⇨ পিতার ভূমিকা: সুরক্ষা ও শৃঙ্খলা, সন্তানকে বাইরের জগতে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তৈরি করা।
অভিভাবকদের এই পার্থক্য সন্তানদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব-
সন্তানদের প্রতি মা-বাবার মনোভাব ও আচরণ সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা ও শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সন্তান পালন পদ্ধতি, মাতৃত্ব-পিতৃত্বের ভূমিকা ভিন্ন হতে পারে, যা সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রভাব ফেলে।
মস্তিষ্কের নিউরোবায়োলজি ও আবেগীয় আচরণ
⇨ মিরর নিউরন সিস্টেম
মাতৃত্ব-পিতৃত্বে মিরর নিউরন (Mirror Neurons) বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি অন্যের অনুভূতি বুঝতে ও একই অনুভূতি অনুকরণ করতে সাহায্য করে, যা সন্তানের আবেগ বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
⇨ মস্তিষ্কের সংযোগ বৃদ্ধি
গবেষণায় প্রমাণিত, সন্তানের প্রতি যত্ন নেওয়ার অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের স্নায়বিক সংযোগকে শক্তিশালী করে, যা অভিভাবকের সহানুভূতি ও ধৈর্যশীলতাকে বৃদ্ধি করে।
আধুনিক জীবনের চ্যালেঞ্জ ও মনস্তাত্ত্বিক সমাধান
⇨ মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা: মা-বাবাদের মধ্যে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন ও বাবা-মায়ের মানসিক চাপ সন্তানের প্রতি সঠিক মনোযোগে বাধা সৃষ্টি করে।
⇨ সামাজিক সমর্থন প্রয়োজনীয়তা: পরিবারের সহায়তা, পরামর্শক, কমিউনিটি গ্রুপ শিশু যত্নে মা-বাবাকে শক্তিশালী করে।
⇨ সুষম পিতৃত্ব: আধুনিক সময়ে পিতামাতার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া সন্তান উন্নয়নে সহায়ক।
পরামর্শ ও সুপারিশ
⇨ সন্তান প্রতি স্নেহ ও শৃঙ্খলা ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
⇨ মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা ও থেরাপি প্রয়োজন হলে তা গ্রহণ করতে হবে।
⇨ পরিবার ও সমাজের তরফ থেকে যথাযথ সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে।
⇨ মা-বাবা নিজে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে সচেষ্ট হতে হবে।
মা-বাবার ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, আচরণ ও মানসিক অবস্থা সন্তানের সামগ্রিক বিকাশের জন্য ভিত্তি। অতএব, সন্তানের সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।