আপনার মন কি বারবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে? জানুন এর পেছনের গভীর মনোবিজ্ঞান ও সমাধান!

আপনার মন কি বারবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে? জানুন এর পেছনের গভীর মনোবিজ্ঞান ও সমাধান!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বিভ্রান্তি ও দ্বিধা কেবল দুর্বলতার নাম নয়-মস্তিষ্কের সংকেত, মানসিক ক্লান্তি, সামাজিক প্রভাব ও আত্মিক সংযোগ বিচ্ছিন্নতার এক সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া "যা করছি সেটা সঠিক তো?" "এ সিদ্ধান্তটা নিলে ভুল হবো না তো?" "নিজেকে নিয়ে কেন এতো অনিশ্চয়তায় ভুগছি?"

এই প্রশ্নগুলো আজকের মানুষের প্রতিদিনকার মানসিক বাস্তবতা। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, বিয়ে, ধর্মীয় পথ অনুসরণ, এমনকি খাবারের মেনু নির্বাচনেও আমরা অনেকে কঠিন দ্বিধা ও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ি।

কিন্তু কেন?? 

মানুষ কেন দিন দিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে? 

কেন মনের মধ্যে এত 'কী করবো, কী করবো না' ঘুরপাক খায়?

মনোবিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স, সমাজতত্ত্ব ও ইসলামী আধ্যাত্মিকতা-সবদিক মিলিয়ে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজলে আমরা দেখতে পাই যে, বিভ্রান্তি ও দ্বিধা হলো একটি বহুমাত্রিক মানসিক প্রক্রিয়া।

 

মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল কেন্দ্র হলো Prefrontal Cortex। এটি যুক্তি-বুদ্ধি, সমস্যা সমাধান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার জন্য কাজ করে। কিন্তু এর পাশেই Amygdala নামে আরেকটি অংশ কাজ করে, যা নিয়ন্ত্রণ করে ভয়, উদ্বেগ ও আবেগ।

যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন Prefrontal Cortex বিশ্লেষণ শুরু করে, আর Amygdala ভয় দেখাতে থাকে-
"ভুল করলে কী হবে?"

"আগে যেমন ব্যর্থ হয়েছিলে, আবারও হবে।"

এই দ্বন্দ্ব যখন দীর্ঘ হয়, তখন মানুষ স্থবির হয়ে যায়-জানি, কিন্তু করবো না। বুঝি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।এটাই বিভ্রান্তির মূল নিউরোসাইকোলজিকাল কারণ।
 

 

স্নায়ুর পথ তৈরি হওয়া বা "Neural Path Dependency"

আমাদের মস্তিষ্ক অতীতে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বা যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেয়।

যদি কেউ ছোটবেলা থেকে শিখে থাকে-"ভুল করলে অপমান হবে", "নিজে কিছু করলে কেউ সাহায্য করবে না", তাহলে সেই মানুষের মস্তিষ্ক এমন এক স্নায়ুবন্ধ তৈরি করে যা তাকে ঝুঁকি নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে। এ কারণে বড় হলেও, সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে—ভয় পায়, পিছিয়ে থাকে।


সচেতন ও অবচেতন মন (Conscious vs Subconscious Conflict)

মানুষের আচরণ শুধু যুক্তি নয়, অবচেতন মন থেকেও চালিত হয়।
❝জানি যে এটা ঠিক, তবুও মন চাইছে না❞—এই ধরণের অনুভূতি অবচেতন মনের ভেতরে জমে থাকা পুরনো ভয়, দুঃখ, বা ভুল বিশ্বাসের ফল। অনেক সময় অবচেতন মনে নিজেকে অযোগ্য ভাবা, বা 'আমি পারবো না'—এই বোধই বারবার ভুল সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্ত না নেওয়ার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 

সামাজিক চাপ ও তুলনা: "Decision Paralysis" এর আধুনিক রূপ

বর্তমান যুগ তথ্য ও বিকল্পে ভরা। একটিমাত্র সিদ্ধান্তের জন্য অসংখ্য অপশন-

"কোন ক্যারিয়ার বেছে নেব?"

"কোন মানুষটিকে জীবনসঙ্গী করব?"

"কোনটা ধর্মসঙ্গত আর কোনটা নয়?"

এই অপশন ও তথ্যবন্যা মানুষকে Decision Paralysis বা 'অবস্থাগত স্থবিরতা'তে ফেলে দেয়।
মনোবিজ্ঞানে একে বলে "Analysis Paralysis"-অর্থাৎ বেশি বিশ্লেষণের ফলে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।

 

Depression ও Anxiety-এর প্রভাব

দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা decision-making এর ক্ষমতা দুর্বল করে।
মানুষ তখন নিজের চিন্তাকে বিশ্বাস করতে পারে না, অনিশ্চয়তার মধ্যে গুমরে মরে।
বিশেষ করে Generalized Anxiety Disorder (GAD) রোগীদের মধ্যে দেখা যায়-তারা সবকিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করে, কোনো বিষয়েই স্থির হতে পারে না। এমন মানসিক অবস্থা থেকে জন্ম নেয় একের পর এক বিভ্রান্তি।
 

আধ্যাত্মিক বিচ্ছিন্নতা ও অন্তঃস্থ শূন্যতা

ইসলামী দৃষ্টিকোণে, মানুষের মধ্যে দ্বিধা ও বিভ্রান্তির একটি গভীর কারণ হলো-আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্ছিন্নতা।
যখন কোনো মানুষ দুনিয়ার মোহ, ভয়, চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বে পড়ে যায়, তখন তার হৃদয় দূর্বল হয়ে যায়। সিদ্ধান্তের সময় সে একরকম অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়ে। কুরআনে আল্লাহ বলেন:

"যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরায়, তার জন্য থাকবে সংকুচিত জীবন।"(সূরা ত্বাহা ২০:১২৪)

এ সংকোচ মানে শুধু দারিদ্র্য নয়, বরং হৃদয়ের ভিতরে স্থায়ী এক অস্থিরতা।

শয়তানের ওয়াসওয়াসা: সন্দেহ ও জড়তার ফাঁদ

ইসলামে বলা হয়েছে, শয়তান মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়। সে বলে-
"তুই পারবি না", "এটা করলে মানুষ কী বলবে", "তোর মতো লোকের পক্ষে সম্ভব না"-
এগুলো বাস্তবতা নয়, বরং মনে ছড়ানো একধরনের আত্মা-ভাঙা প্ররোচনা।

শয়তানের এই কৌশল মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে রাখে।
 

সমাধানের পথ: বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়

⇨ নিজেকে জানুন: আত্ম-অনুসন্ধান (Self-reflection) দ্বিধা ভাঙার প্রথম ধাপ

⇨ তথ্য জোগাড় করুন: সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণ বিভ্রান্তি কমায়

⇨ ইস্তিখারা করুন: দ্বিধার সময় আল্লাহর কাছ থেকে দিকনির্দেশনা চাইতে হয়

⇨পরামর্শ নিন: বিশ্বস্ত কাউকে বলা, নিজের চিন্তা প্রকাশ করাও অনেক সময় বিভ্রান্তি দূর করে

⇨ কিছু ভুল হবে-এটিই বাস্তবতা: ভুল হওয়াটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেয়ে খারাপ নয়

⇨ আত্মার প্রশান্তি আনুন: নামাজ, তিলাওয়াত, ইবাদতের মাধ্যমে আত্মিক শক্তি ফিরে আসলে মস্তিষ্কও স্থির হতে শুরু করে

⇨ আত্মবিশ্বাস চর্চা করুন: ছোট সিদ্ধান্ত নিজে নিয়ে সফলতার অভিজ্ঞতা অর্জন করুন
 

মানুষের বিভ্রান্তি কোনো একদিনের সমস্যা নয়। এটা তার মস্তিষ্ক, স্মৃতি, পরিবেশ ও আত্মার সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া। তবে এই বিভ্রান্তি অন্ধকার নয়-এই চিন্তার মধ্যেই আছে পরিশুদ্ধির সুযোগ।

যখন আমরা সাহস করে চিন্তাকে চিন্তায় থামিয়ে সিদ্ধান্ত নেই, তখনই আমরা বিভ্রান্তিকে পরাজিত করি।
আর যখন আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করি, তখন সেই সিদ্ধান্ত আলোর পথে এগিয়ে যায়-even যদি পথ কাঁটাময় হয়। দ্বিধা হোক না যত গভীর, বিশ্বাস ও জ্ঞান থাকলে তার ভেতর দিয়েও তৈরি হয় সবচেয়ে পরিণত সিদ্ধান্ত।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ