মানুষ কীভাবে রূপ নেয় হিংস্র জানোয়ারে? মানবতার পতনে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ!

মানুষ কীভাবে রূপ নেয় হিংস্র জানোয়ারে? মানবতার পতনে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একজন সাধারণ মানুষ যিনি পরিবার ভালোবাসেন, সহানুভূতিশীল সে-ই হঠাৎ হয়ে উঠতে পারেন একজন নিষ্ঠুর হিংস্র ব্যক্তি। যুদ্ধ বা দাঙ্গার সময়ে যেন মুছে যায় সেই মানবিক সত্তা। প্রশ্ন জাগে, এটা কি মনুষ্যত্ব হারানোর প্রক্রিয়া, নাকি একটি মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর?

মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কিছু মানসিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে সহানুভূতি, দায়বদ্ধতা, এমনকি নিজের সত্তাকেও।
 

যুদ্ধ বা দাঙ্গায় 'মানবিকতা' হারানোর স্নায়ুবিজ্ঞান:

১. Deindividuation (স্বত্বার বিলুপ্তি):

যখন ব্যক্তি কোনো বৃহৎ দল বা ভিড়ের অংশ হয়ে যান, তখন তার ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও দায়বোধ দুর্বল হয়ে পড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, সংঘর্ষ বা দাঙ্গার সময় অনেকেই বলে থাকেন,

"আমি একা করিনি, সবাই করছিল।"

এই অবস্থায় prefrontal cortex যেটা যুক্তি ও নৈতিকতা নিয়ন্ত্রণ করে তা সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়, আর amygdala ও limbic system হয়ে ওঠে অধিক সক্রিয়, যা রাগ, ভয় ও প্রতিশোধপ্রবণতাকে উস্কে দেয়।

 

২. Moral Disengagement (নৈতিক বিচ্ছিন্নতা):

এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে বিশ্বাস করান তার সহিংস কাজটি ন্যায়সঙ্গত বা অপরিহার্য।

"ওরা শত্রু, তাই মারাই উচিত" বা "ধর্ম বা জাতির জন্য এটা দরকার।"

এই cognitive distortion এর মাধ্যমে মানুষ অপরাধবোধ ছাড়াই বর্বরতা ঘটাতে পারে।

 

মনস্তাত্ত্বিক ট্রিগারসমূহ:

☞  Groupthink ও In-group Bias:

যেখানে নিজের দলকে সবসময় 'ভালো' ও 'ন্যায়পরায়ণ' ভাবা হয়, আর বিপক্ষকে দেখা হয় হুমকি বা অমানবিক শত্রু হিসেবে।
 

☞  Desensitization (সংবেদনশীলতার অবসান):

ঘন ঘন সহিংসতা, হিংসাত্মক ভাষা বা গুজবে অভ্যস্ত হলে মানুষের মস্তিষ্ক সেই দৃশ্যের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। একে বলা হয় emotional numbing যেখানে সহানুভূতির ঘাটতি হয়।
 

☞ Fear Conditioning:

যুদ্ধ বা দাঙ্গা চলাকালে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ভয়ের স্মৃতি (fear memory) তৈরি হয়। Amygdala সেই ভয়কে ভবিষ্যতের হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে, ফলে আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
 

Social Experiment ও Research যা বলে-

১. Stanford Prison Experiment (1971):
সাধারণ শিক্ষার্থী যখন কয়েদি ও প্রহরীর ভূমিকায় ভাগ করা হয়, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রহরীরা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।

বুঝায়, power dynamics ও role assignment কিভাবে ব্যক্তিগত নৈতিকতাকে অকার্যকর করতে পারে।
 

২. Milgram Experiment:
মানুষ কত সহজে অন্যকে আঘাত করতে প্রস্তুত হয়, যদি তাকে "অধিকর্তার আদেশ" বলা হয়—এই গবেষণায় তা দেখানো হয়েছে।
 

ফলাফল :

⇨ PTSD (Post-Traumatic Stress Disorder): সহিংসতায় জড়ানো মানুষরা পরবর্তীতে নিজেই মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হন।

⇨ Emotional Disintegration: সহানুভূতি, লজ্জা, ও আত্মগ্লানি হারিয়ে গেলে ব্যক্তি আস্তে আস্তে মানসিকভাবে নিষ্ক্রিয় বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

⇨ Generational Trauma: দাঙ্গার অভিজ্ঞতা শুধু একজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।
 

মানুষ অমানবিক হয় না হঠাৎ করে। এটি একটি ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা মনস্তাত্ত্বিক ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যেখানে ভয়, পক্ষপাত, দমনকৌশল এবং সমাজের চাপ মিলে মানুষকে করে তোলে নির্মম, নিঃসংশয়, এবং অনেক সময় আত্মবিস্মৃত। যুদ্ধ বা দাঙ্গা কেবল অস্ত্রের লড়াই নয় এটা মানুষের ভিতরের মানবিক বোধের সঙ্গেও যুদ্ধ। আর জয় তখনই, যখন মানুষ এই প্রক্রিয়াকে চিনতে শিখে, প্রতিরোধ করতে শেখে। মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি তার মানবিকতা আর সেটাই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার। তাই সহিংসতার মুখে দাঁড়িয়ে মানবিকতা টিকিয়ে রাখাই হোক আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিরোধ।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ