ভরসা নাকি সন্দেহ? মানবিক সম্পর্ক নির্ধারণে মস্তিষ্কই বলে দেয়-কাকে বিশ্বাস করবেন, কাকে নয়!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিশ্বাস একটি শব্দ মাত্র, কিন্তু এর প্রভাব বিস্তৃত ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সমাজ, রাজনীতি ও ব্যবসার প্রতিটি কোণে। আমরা অনেক সময়ই বলি, 'এই মানুষটা বিশ্বাসযোগ্য', বা 'ওর মধ্যে কিছু একটা গলদ আছে'। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই সিদ্ধান্তগুলো আমরা নিছক অভিজ্ঞতা ও আবেগ দিয়ে নেই, নাকি আমাদের মস্তিষ্ক কোনো সুনির্দিষ্ট সংকেত পড়ে এমন সিদ্ধান্ত দেয়?
সাম্প্রতিক স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ বলছে, মানুষের মধ্যে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস গঠনের পেছনে রয়েছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং জৈবিক কিছু কার্যপ্রক্রিয়া। যার সূচনা ঘটে শৈশব থেকেই এবং নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের মাধ্যমে।
বিজ্ঞান যা বলছে- মস্তিষ্কে একটি নির্দিষ্ট নিউরোহরমোন অক্সিটোসিন, যা সাধারণভাবে 'ট্রাস্ট হরমোন' নামে পরিচিত, বিশ্বাসের অনুভূতি গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। চোখে চোখ রাখা, সহানুভূতি পাওয়া বা স্পর্শের মতো মানবিক অভিজ্ঞতা অক্সিটোসিন নিঃসরণ বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে amygdala-তে ভয়ের প্রতিক্রিয়া কমে এবং prefrontal cortex যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে এভাবে মস্তিষ্ক বিশ্বাসযোগ্যতা বিচার করে।
তবে, এই হরমোনের মাত্রা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কেউ সহজেই বিশ্বাস করে, আবার কেউ ছোট ছোট ইঙ্গিতেও সন্দেহ করে বসে। যারা শৈশবে অবহেলার শিকার হয়েছে বা প্রতারণার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অবিশ্বাস বেশি কাজ করে।
মনস্তাত্ত্বিক ছাঁচে বিশ্বাসের গঠন-
বিশ্বাস গঠনের মনস্তত্ত্ব বহু স্তরে গঠিত। Secure Attachment Theory মতে, শিশুকালে যদি অভিভাবকের ভালোবাসা, উত্তরদায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার ও স্থিতিশীল পরিবেশ থাকে, তবে ব্যক্তির মধ্যে বিশ্বাসের ভিত্তি শক্ত হয়। বিপরীতে, অবহেলা বা মানসিক আঘাতবিশিষ্ট শিশুরা বড় হয়ে অনিরাপত্তা, ভয় ও সন্দেহের সঙ্গে বেড়ে ওঠে, ফলে প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে তারা কারো প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। তবে মনোবিজ্ঞান জানায়, মানুষ পুরোপুরি অবিশ্বাসপ্রবণ হয় না-তারা 'নিরাপদ মনে হওয়া' ব্যক্তি বা পরিস্থিতির সঙ্গেই বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করে।
সমাজ ও পরিবেশের ভূমিকাও বিশাল-
যে সমাজে বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা ও দুর্নীতি বেশি, সেখানে একটি "সামাজিক অবিশ্বাস" তৈরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অনিশ্চিত, অস্থির ও অপরিচিত পরিবেশে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বেশি রক্ষণশীল ও সন্দেহপ্রবণ হয়। আবার এমন সমাজে, যেখানে পারস্পরিক সহানুভূতি, সহানুভূতিশীল যোগাযোগ ও দায়বদ্ধতা প্রচলিত বিশ্বাসের সংস্কৃতি বিকশিত হয় সহজে।
বিশ্বাস ভাঙে কেন?
বিশ্বাস গড়ে তুলতে সময় লাগে, কিন্তু ধ্বংস হতে পারে মুহূর্তে। একবার বিশ্বাসভঙ্গ ঘটলে মস্তিষ্কে সেই ঘটনার ছাপ গেঁথে যায়-এমনকি আবার কোনো নতুন সম্পর্কেও সেই 'সতর্কতা' সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই অনেকেই অতীতের অভিজ্ঞতা বর্তমান সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলে দেয়।
মনোবিজ্ঞান মতে, এটিকে বলে "Cognitive Bias Anchoring"- অর্থাৎ, আগে ঘটে যাওয়া কিছু নেতিবাচক ঘটনার স্মৃতি ভবিষ্যতের মূল্যায়নকে প্রভাবিত করে।
বিশ্বাস কেবল একটুকরো আবেগ নয় এটি একটি স্নায়ুবিজ্ঞানভিত্তিক জটিল প্রতিক্রিয়া, যা মানবিক আচরণ, শারীরিক প্রতিক্রিয়া এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এক সুনির্দিষ্ট সংমিশ্রণ।
আমরা কাকে বিশ্বাস করব তা আসলে শুধু মন দিয়ে নয়, মস্তিষ্কের অদৃশ্য সংকেত বুঝে তৈরি হয়। তাই কারো আচরণকে বিচার করার আগে বুঝতে হবে তার বিশ্বাস বা অবিশ্বাস শুধু 'মনোভাব' নয়, বরং তার মস্তিষ্ক, অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের সম্মিলিত প্রতিফলন।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।