বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের আঘাত শিশুর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার ওপর যেভাবে প্রভাব ফেলে-গবেষণায় যা জানা গেছে

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের আঘাত শিশুর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার ওপর যেভাবে প্রভাব ফেলে-গবেষণায় যা জানা গেছে
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একটা সংসারের ভাঙন শুধু দুই প্রাপ্তবয়স্কের সম্পর্ক নয়—তার প্রতিধ্বনি বহু সময় ধরে থেকে যায় একটি শিশুর মস্তিষ্ক, মন ও ব্যবহারিক জীবনে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের পরে শিশুরা অনেক সময় নিজের ভাষায় প্রকাশ না করতে পারলেও, তাদের আচরণ, আত্মপ্রকাশ, বন্ধন গড়া ও আত্মমর্যাদাবোধে পরিবর্তন দেখা যায়। এই পরিবর্তনগুলোকে ঘিরে বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে গত কয়েক দশকে। এবং প্রায় সব গবেষণায়ই উঠে এসেছে এক গভীর সত্য বিচ্ছেদ শিশুর উপর দীর্ঘমেয়াদী মানসিক ছাপ রেখে যায়, যদিও এর প্রকৃতি নির্ভর করে পরিস্থিতি, পারিবারিক আচরণ ও শিশুর বয়সের ওপর।

বাস্তব গবেষণায় যা উঠে এসেছে -

১. আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তাবোধ কমে যায়:

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিচ্ছেদের পরে শিশুরা পরিবারকে নিরাপদ জায়গা হিসেবে দেখার ক্ষমতা হারায়। বিশেষ করে যদি পরিবারে কলহ, চিৎকার, বা হঠাৎ বিচ্ছেদ হয় তবে শিশুর মধ্যে 'trust issue' বা বিশ্বাসের সংকট গড়ে ওঠে, যা পরবর্তী জীবনে বন্ধুত্ব বা সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
 

২. আচরণগত সমস্যা ও হঠাৎ বদল:

ছোট শিশুরা হয়তো বেশি চুপচাপ হয়ে যায়, বিছানা ভিজানো বা আঙুল চোষা আবার শুরু করতে পারে। টিনএজ বয়সে থাকা শিশুরা রাগ, হতাশা, স্কুল এড়িয়ে চলা বা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে জড়িয়ে পড়তে পারে। কিছু ক্ষেত্রে স্কুল পারফরম্যান্স নেমে যায়, মনোযোগ কমে, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। 
 

৩. নিজেকে দোষী ভাবা বা বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া:

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ করে ৬–১০ বছরের শিশুদের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা যায়—তারা ভাবে বিচ্ছেদের জন্য তারই কোনো আচরণ দায়ী। এ ধরনের ভুল চিন্তা থেকে মানসিক চাপ তৈরি হয়, যা ডিপ্রেশন বা উদ্বেগে রূপ নিতে পারে।
 

৪. শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা:

গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব শিশু উচ্চ মানের সামাজিক সহায়তা পায় না বা যেখানে বিচ্ছেদের পরে বাবা-মায়ের মধ্যে টানাপোড়েন চলতেই থাকে সেখানে শিশুরা লক্ষ্যহীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে।

 

বয়সভেদে প্রভাব -

⇨ ৩–৫ বছর: বিচ্ছেদের অর্থ পুরোপুরি না বোঝার কারণে এরা বেশি বিচলিত হয় আচরণগতভাবে—ঘুমের সমস্যা, মা বা বাবার প্রতি চরম আকর্ষণ।

⇨ ৬–১২ বছর: 'কার দোষে সম্পর্ক ভাঙল' সেটা বোঝার চেষ্টা করে, আত্মগ্লানি তৈরি হয়, অনেক সময় স্কুলে আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়।

⇨ ১৩–১৮ বছর: ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বাড়লেও, সম্পর্ক নিয়ে ভীতি তৈরি হয়, অনেকেই নিজের প্রেম বা বন্ধন সম্পর্কেও হতাশ হয়ে পড়ে
 

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যদি বাবা-মা শান্তিপূর্ণভাবে আলাদা হন, এবং উভয় পক্ষই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য, রুটিন ও ভালোবাসার পরিবেশ বজায় রাখতে সচেষ্ট হন তবে শিশুর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি হয়। শান্তিপূর্ণ সহ-অভিভাবকত্ব (co-parenting), খোলামেলা সংলাপ এবং পেশাদার কাউন্সেলিং শিশুদের ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করতে পারে।
 

যেভাবে শিশুকে রক্ষা করা যায় এই প্রভাব থেকে:

তাকে বারবার বোঝান, বিচ্ছেদের জন্য সে দায়ী নয়। কাউন্সেলিং বা থেরাপির কথা বিবেচনা করুন। তাকে দুজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবেন না, দ্বন্দ্ব বা বিরোধ শিশুর সামনে আনবেন না। 

বিচ্ছেদ কখনও কখনও অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তা যেন শিশুর জীবনের ভরকেন্দ্র না নাড়িয়ে দেয়। তারা যেন ভালোবাসা, বোঝাপড়া ও নিরাপত্তা পায় তা নিশ্চিত করাই অভিভাবকের দায়িত্ব। শিশুরা বড় হয় পরিবেশ দেখে, কথায় নয় তাই বিচ্ছেদের পরেও একজন শিশু যেন পরিবার-সম্পর্কের বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলে, সেটাই সবচেয়ে জরুরি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ